জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে রাশিয়া
জাহাজ নির্মাণ খাতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করতে চাইছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম দেশটি বেসামরিক জাহাজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম সরবরাহ নিয়ে সংকটে পড়ার পর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে শক্তিশালী করার ইঙ্গিত দেন। এরপরই রাশিয়া জাহাজ খাতে জনশক্তি আমদানিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
রাশিয়ার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে দেশের সরকারি মালিকানাধীন জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসল)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
বোয়েসেল-এর বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, প্রাথমিকভাবে একাধিক রাশিয়ান সংস্থা জাহাজ নির্মাণে উচ্চদক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রায় ১০০ কর্মী চেয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে কোম্পানিগুলো মূলত স্ক্যাফোল্ডিং (বিল্ডার), হাল ফিটার (ধাতব জাহাজ), মেরিন মেশিন ফিটার, মেরিন পাইপ ফিটার এবং ওয়েল্ডিংয়ের জন্য কর্মী নিয়োগ করতে আগ্রহী।
(বোয়েসেল)-এর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শ্রমিকদের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে পারে।
বোয়েসেল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মল্লিক আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আমরা একবার রাশিয়ার বাজারে প্রবেশ করলে সেখানে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতে পারে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি'।
'বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রচুর লোক কাজ করছে। এছাড়া মেরিন টেকনোলজির বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক দক্ষ লোক বেরিয়ে আসছে। সুতরাং এটি তাদের জন্য ভালো সুযোগ হবে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশের মোট ছয়টি মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট রয়েছে যেগুলো থেকে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী বের হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বর্তমানে অসংখ্য বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। সিঙ্গাপুরের পর রাশিয়া বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য আরেকটি প্রতিশ্রুতিশীল গন্তব্য হতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বোয়েসেল সূত্রে জানা গেছে, আগ্রহী প্রার্থীদের দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর বা অন্য কোনো দেশের আন্তর্জাতিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ন্যূনতম ছয় মাস কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বোয়েসেল সার্ভিস চার্জসহ রাশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের মাইগ্রেশন খরচ হবে প্রায় ৪২ হাজার টাকা। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে কর্মীদের বেতন ৬৫ হাজার টাকা থেকে ৮৫ হাজার টাকা (৩৮ হাজার ৮৫০ থেকে ৫০ হাজার রাশিয়ান রুবল) পর্যন্ত হবে।
এর বাইরে রাশিয়ায় বিমান ভাড়া, বাসস্থান ও পরিবহন খরচ নিয়োগকর্তারাই বহন করবে। অন্যদিকে কর্মীদের খাওয়ার ব্যবস্থা ও খরচ নিজেদেরই বহন করতে হবে।
নির্বাচিত প্রার্থীদের প্রতি বছর তিন থেকে পাঁচ মাস মাইনাস ১১ থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাজ করতে হয়।
আগ্রহী প্রার্থীরা বোয়েসেল-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া লিঙ্ক ব্যবহার করে অনলাইনে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ান ফেডারেশনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান পূর্ব রাশিয়ার শহর ভ্লাদিভোস্টকের গভর্নরকে প্রিমর্স্কি অঞ্চলে ভ্লাদিভোস্টকের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগের অনুরোধ করেন।
এ সময় রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরের জাহাজ নির্মাণ শিল্পেই বর্তমানে ৬০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০টি আন্তর্জাতিক ও ১০০টি স্থানীয় শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড বছরে প্রায় ১০০টি জাহাজ নির্মাণ করে।
শ্রমনির্ভর এই খাতে বর্তমানে দেড় লাখেরও বেশি দক্ষতা সম্পন্ন কিংবা মোটামুটি মানের দক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। আনুমানিক ২০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
রাশিয়া বাংলাদেশিদের নিয়মিত শ্রম অভিবাসন গন্তব্য নয়। তবে অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশটিতে পাড়ি জমায়।
১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা রাশিয়ান স্টেট স্কলারশিপ স্কিমের অধীনে বৃত্তি পেয়ে আসছে। রাশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করেছে।
যন্ত্রাংশ আমদানিতে সংকটের মুখে জাহাজ শিল্পখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য রাশিয়ার
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা তাস-এর প্রতিবেদন অনুসারে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি বলেন, রাশিয়ান জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো বেসামরিক জাহাজের জন্য বিদেশি সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ নিয়ে সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
১৮ আগস্ট জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়নে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একটি বৈঠকের সময় তিনি বলেন, 'কারণটি অজানা নয়। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদেশি অংশীদাররা তাদের প্রতিশ্রুতির সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।'
'বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও আমাদের পশ্চিমা অংশীদারদের কার্যকলাপে আবারও বোঝা গেছে যে জাহাজ নির্মাণ খাতে দক্ষতা বিকাশে আমাদের নিজেদেরই সক্রিয় হতে হবে,' বলেন তিনি।
'আমদানিকৃত প্রতিটি যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয় এবং এর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামাদি ও উল্লেখযোগ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা প্রয়োজন,' বলেন পুতিন।
'রাশিয়ায় জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছু ঠিকমতো যোগান দেওয়া ও পরিচালনার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে,' বলেন তিনি।