প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই গ্রামীণ নারীদের সফল উদ্যোক্তায় পরিণত করেছেন রুহী মোস্তফা
কলেজ শিক্ষার্থী সাবরিন শান্তা ঊর্মি ১ বছর আগে মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি সেলাই প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। প্রশিক্ষণ শেষে বিনামুল্যে একটি সেলাই মেশিনও দেওয়া হয় তাকে। ঘরে বসে সেলাই করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে পড়াশোনা ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি সংসার খরচ মেটাতেও কাজে আসছে।
ঊর্মির মতো মিরসরাই উপজেলার অন্তত ৩০ জন নারী বিনামুল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ এবং সেলাই মেশিন পেয়ে পরিবারে বাড়তি আয়ের অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন। তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছেন চট্টগ্রামের নারী উদ্যোক্তা রুহী মোস্তফা।
শুধু মিরসরাই উপজেলাই নয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৩ শতাধীক নারী রুহী মোস্তফার সহযোগীতায় স্বাবলম্বী হয়েছে। এদের বেশিরভাগই মফস্বল এলাকার নারী।
ইউনিয়ন পরিষদ এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন, বুটিক, কম্পিউটার সহ বিভিন্ন উপকরণ প্রদান করছেন। আর এতে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে।
তাদের মধ্যে অনেকেই হয়েছেন নারী উদ্যোক্তা। রুহী মোস্তফার উদ্যোগগুলো প্রান্তিক নারীদের বাড়তি আয়ের মাধ্যমে সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে ভুমিকা রাখছে।
চট্টগ্রামে যে ক'জন নারী সংগঠকের হাত ধরে চট্টগ্রাম ওমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো এদের একজন রুহী মোস্তফা। ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের পৃথক পরিচয় সৃষ্টি করতে এই উদ্যোক্তা গত ২২ বছর ধরে চট্টগ্রামে কাজ করছেন।
এসেনশিয়াল ক্যাটারিং অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফটস নামে এই উদ্যোক্তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ফ্রোজেন অ্যান্ড ফ্রাই ফুড আইটেম বিক্রি হয় আগোরা, স্বপ্ন, মিনা বাজার, চিটাগং ক্লাব, খুলশি মার্ট, ল্যাভেন্ডার সিএসডি, নান্দনিক, রেডিসন ব্লু, মেহেদি মার্ট এর মত মেগা শপিং মলে। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রায় ১০০ কর্মী।
ব্যবসা থেকে যে আয় হয় তার বড় একটি অংশ রুহী ব্যয় করেন নারীদের স্বাবলম্বী করতে। প্রশিক্ষণ এবং উপকরণ বিতরণ করে এসব নারীদের পরিবারে বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি।
ব্যক্তি উদ্যোগে তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ নারীকে স্বাবলম্বী করেছেন। ব্যবসার আয় থেকে বছরে এই নারী উদ্যোক্তা বিভিন্ন সমাজিক কাজে ব্যয় করেন ১০ লাখ টাকার বেশি।
রুহী মোস্তফা সামাজিক উদ্যোগের ব্যাপ্তি আরো বাড়াতে চান। এজন্য ব্যবসার পরিধিও বাড়ানোর পরিকল্পনা তার। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তার প্রতিষ্ঠানের পণ্য আমেরিকায় রপ্তানির পরিকল্পনা করছেন। আগামী ৬ মাসের মধ্যে সেটি সম্ভব হবে প্রত্যাশা তার।
নারী উদ্যোক্তা পথচলা, চ্যালেঞ্জ, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন রুহী মোস্তফা।
যেভাবে শুরু
রুহী মোস্তফার বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম শহরে। উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা খায়রুল মোস্তফার সাথে বিয়ে হয় তার। স্বামীর ব্যস্ততার মাঝেও সংসার সামলিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক পাশ করেন রুহী মোস্তফা।
তখন ২০০০ সাল। চিন্তা করেছিলেন চাকরি করবেন। কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠেনি। স্বামীর পরিচিতির সূত্র ধরেই নতুন করে স্বপ্ন দেখলেন উদ্যোক্তা হবেন। ব্যবসা করবেন। কিন্তু হাতে তখন মূলধনও নেই।
পরিবারে খাবারের যেসব আইটেম ছিলো প্রায় ১ হাজার টাকা মুল্যের সেসব আইটেম দিয়ে তৈরী করলেন হোম মেইড ফুড, সিঙ্গারা চমুচা। বিক্রিও হচ্ছিল। লাভের টাকা হাতে আসায় ব্যবসার প্রতি ঝোঁকও বাড়তে থাকে রুহী মোস্তফার। বলতে গেলে সেই ১ হাজার টাকাই রুহী মোস্তফার ব্যবসার পুঁজি।
এরপর ২০০১ সালে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগে শুরু করেন এসেনশিয়াল ক্যাটারিং অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফটস। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার গ্রাহক পরিধি। দেশের চেইন সুপার শপগুলোতে তার প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ শুরু হতে থাকে।
রুহী মোস্তফা বর্তমানে ওমেন চেম্বারের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। একসময় সংগঠনটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইনার হুইল ক্লাব আগ্রাবাদের সভাপতি ছিলেন। সম্পৃৃক্ত আছেন চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব, রোটারি ক্লাব, কালার্স অব লাইফ সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের আয়োজনে নানা সেশন, ট্রেনিং, প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত আয়োজনেও দেশে এবং বিদেশে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ব্যাংকক, দুবাই, সিঙ্গাপুর, ইউকে, বেলজিয়াম, আমেরিকা এমন সব দেশে গিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাগুলো বিনিময় করছেন নতুন উদ্যোক্তাদের সাথে।
সময়ের পরিক্রমায় চট্টগ্রাম ওমেন চেম্বার এখন ১৫০০ জনের বিশাল পরিবার । গত ২২ বছরে এই সংগঠন হাজারো নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছে। এই অর্জনের বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছেন রুহী মোস্তফা।
চট্টগ্রামের হোম মেড ফুড ব্যবসায়ী নারগিস আক্তার বলেন, "এসেনশিয়াল ফুড ফ্যাক্টরি থেকে কাজ শিখে এখন আমি নিজেও এই খাতে ব্যবসা করছি। প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় হয় আমার। এটিই এখন পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। আর এই সুযোগটি করে দিয়েছেন রুহী মোস্তফা।"
রুহী মোস্তফা বলেন, "আমি চাই নারীরা উদ্যোক্তা হোক। তারা আয় করে সংসার স্বচ্ছল করে ভূমিকা রাখুক। এখনো গ্রামের মেয়ে যারা উদ্যোক্তার বিষয়টি বুঝেনা। আমার মুল ফোকাস গ্রামের নারীরা। আমার সামাজিক উদ্যোগ এবং ব্যবসা একই সুতোয় গাঁথা। ব্যবসার পরিধি যত বাড়তে সামাজিক কর্মকাণ্ডও বাড়াতে পারবো।"