হেঁটে সমাবেশস্থলে, খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন বিএনপির নেতাকর্মীদের
আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। পরিবহন ধর্মঘট থাকায় সেই সমাবেশকে সফল করতে বুধবার দিবাগত রাত থেকেই রাজশাহী আসছেন বিএনপির বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা। পুলিশের বাধার কারণে বুধবার রাতে তাদের অনেক নেতাকর্মী খানিক রাস্তা বাসে, খানিক রাস্তা হেঁটে এসে সমাবেশস্থলের পাশেই ঈদগাহ ময়দানে অবস্থান নিচ্ছেন। অনেকেই বৃহস্পতিবার দুপুরে ট্রেনে করে এসেছেন। আবার আশপাশের জেলা থেকে অনেক নেতাকর্মী সিএনজি, নসিমন, করিমন, ইমা গাড়িতে করে ভেঙে ভেঙে সমাবেশস্থলে এসে পৌঁছেছেন।
যারা বুধবার রাতে এসে পৌঁছেছেন, তাদের বেশিরভাগ ঈদগাহ ময়দানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন। অনেকে পদ্মা নদীর তীরে খোলা জায়গায় তাঁবু টানিয়ে থেকেছেন। অনেকে পদ্মা গার্ডেনে খোলা জায়গায় থেকেছেন। নারীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে নগরীর বিভিন্ন কনভেনশন সেন্টারে। এছাড়া অনেকেই নগরীতে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন, মহানগর, জেলা ও ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়ে রাত্রিযাপন করছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর ঈদগাহ ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক হাজার মানুষ প্যান্ডেল ও তাঁবু করে আলাদা আলাদাভাবে অবস্থান করছেন। তাদের বিভিন্নস্থানে কোথাও বিএনপির বগুড়ার শাজাহানপুরের নেতাকর্মী, কোথাও বিএনপির নওগাঁর নজিপুরের নেতাকর্মী, কোথাও পাবনা, কোথাও জয়পুরহাট, কোথাও নাটোর, কোথাও বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আগত নেতাকর্মীদের ব্যানার টানিয়ে রাখা হয়েছে।
তাদের মধ্যে কোনো দল দুপুরের খাবার খাচ্ছে, অনেককে আবার রান্নার প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে।
একটি তাঁবুর নিচে গিয়ে কথা হয় নওগাঁর পত্নীতলা নেপালপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক আবু জাফরের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমরা নওগাঁর পত্নীতলা থেকে ১০ বাস ভর্তি হয়ে বুধবার সন্ধ্যায় রওনা দিই। রাজশাহীর মোহনপুরের ত্রিমোহনীতে রাতে পৌঁছালে পুলিশ আমাদের বাস ফিরিয়ে দেয়। তখন বাস ঘুরিয়ে কয়েক মাইল দূরে পিছিয়ে গিয়ে মাঠের মধ্যে রেখে আসা হয়। সেখান থেকে অনেকে ২০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রাত ৪টায় ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছায়। আমরা রাতে বাসেই গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়েছি।'
তিনি বলেন, 'আমার ঘরের টিন উড়ে গেছে, টিন পাইনি। সার নিতে গিয়েও সার পাই না। অথচ যাদের টিনের দরকার নাই, তারা সরকারের টিন পেয়েছে। এইজন্য সমাবেশে এসেছি, যাতে এই সরকার আর ক্ষমতায় থাকতে না পারে।'
নওগাঁর পত্নীতলা ঘোষনগর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, রাতে তারা খোলা আকাশের নিচে মাঠেই ছিলেন। এই তিন দিন তারা এভাবেই থাকবেন। কষ্ট হবে, কিন্তু সমাবেশ সফল করতে হবে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ইদ্রিস আলীরা চারটি গাড়ি নিয়ে বুধবার সন্ধ্যায় রওনা হয়ে রাত ৪টায় রাজশাহীর ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছান।
তিনি বলেন, বগুড়ার শাজাহানপুর থেকে চারটা বাস নিয়ে এসেছিলেন। রাজশাহীর বানেশ্বরে পুলিশ দুটি বাসের নামে মামলা দেয়। তার মধ্যে একটা গাড়ি জব্দ করে রেখেছে। একটা গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। দুটি বাসকে জরিমানা করেছে ২৫ হাজার টাকা করে। সেখান থেকে আসার পর কাটাখালীতে পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। পরে গাড়ি অনেক ঘুরিয়ে নেতাকর্মীদের নামিয়ে দিয়ে পরে হেঁটে তারা সমাবেশস্থলে পৌঁছেছেন।
ইদ্রিস বলেন, 'আমরা এই তিন দিন থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই নিয়ে এসেছি। চাল, ডাল, তেল, লাকড়ি, উনুন থেকে শুরু করে সব উপকরণ সঙ্গে নিয়ে এসেছি।'
তিনি বলেন, 'বাড়িতে থাকলেও মিথ্যা মামলার শিকার হতে হয়, রাজপথে থাকলেও শিকার হতে হয়। অতএব রাজপথে থাকাই ভালো। আমাদের ৪৯ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমরা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এই সমাবেশস্থলে এসেছি।'
শাহাজাহানপুর ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সাহেব আলী বলেন, 'আমাদের পেট-পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এই সরকারকে না নামিয়ে আমাদের কোনো উপায় নেই।'
ঢাকা মহানগরপূর্ব ছাত্রদলের নেত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস মুক্তা এসেছেন সমাবেশে। তিনি জানান, সাধারণ জনগণ হিসেবে বুধবার দিনে বাসে করে ঢাকা থেকে রাজশাহী আসছেন। থাকছেন আত্মীয়ের বাসায়।
পাবনার সুজানগর থেকে আনিসুর রহমান তারা বুধবার রাত ১২ টায় রওনা হয়ে রাত ৪টায় পৌঁছেছেন। তিনি বলেন, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিভাগীয় সমন্বয়ক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু দাবি করেন, 'গত কয়েকদিনে বিভাগের আট জেলায় ১ হাজার ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের নামে ৬৬টি মামলা হয়েছে। অতিউৎসাহী কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা এসব করছে, যা দেশের অন্য কোনো সমাবেশের আগে হয়নি। আমাদের নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করছে পুলিশ। যতই বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই আমাদের সমাবেশ সফল হবে।'
রাজশাহীতে পরিবহন ধর্মঘট, যাত্রীদের ভোগান্তি
এদিকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ১০ দফা দাবি পূরণ না হওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েেছে। সকাল থেকেই রাজশাহী থেকে ঢাকাসহ দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। চলাচল করছে না আন্তঃজেলা পর্যায়ের কোনো বাস।
রাজশাহী বিভাগীয় পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাফকাত মঞ্জুর বিপ্লব বলেন, মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করাসহ ১০ দফা দাবিতে আল্টিমেটাম দিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ হয়নি। এ কারণে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, 'রাজশাহী থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার বাস আপ-ডাউন করছে। এই ধর্মঘটের কারণে সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। দাবি না মানা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।'
এদিকে ধর্মঘট চলায় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। আনিসুর রহমান নামের এক যাত্রী চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ থেকে বগুড়ার শিবগঞ্জে যাবেন। তার স্ত্রী অসুস্থ। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট থাকায় তাকে ভেঙে ভেঙে নসিমনে যেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'যেখানে ভাড়া লাগত ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, সেখানে ভেঙে ভেঙে যাওয়ার কারণে ১ হাজার টাকার মতো লাগছে।'
মিজানুর রহমান নামের এক যাত্রী জানান, তার বিকেলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আছে। কিন্তু তিনি নেটওয়ার্কের বাইরে থাকায় পরিবহন ধর্মঘটের বিষয়টা জানতেন না। পরীক্ষা দিতে না পারলে তার ইয়ার ড্রপ হয়ে যাবে।
লোকসানের শিকার হচ্ছেন বাস মালিকরাও। কয়েকজন বাস মালিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, বাস বন্ধ থাকার কারণে তাদের ব্যাপক লোকসানের শিকার হতে হচ্ছে। শুধু রাজশাহী থেকেই বিভিন্ন আন্তঃরুটে চলাচল করে ৫৩৭টি বাস। তিন দিনের বন্ধে শুধু রাজশাহীর মালিকদের দুই থেকে তিন কোটি টাকার লোকসান হবে বলে জানান তারা। এছাড়া রংপুর, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জের বাসও বন্ধ থাকায় আরও কয়েক কোটি টাকার লোকসান হবে তাদের। এরপর আবার ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের সময়ও বাস বন্ধ রাখতে হতে পারে বলে একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন বাস মালিকরা।
এছাড়া রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কার্ডধারী শ্রমিক রয়েছেন ৫ হাজার ৬০০ জন। যারা বাস, সিএনজি, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংক-লরি চালান। এই পরিবহন ধর্মঘটের কারণে তাদেরও ব্যাপক ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
রাজশাহী থেকে বিভিন্ন রুটে রাব্বি পরিবহন নামে ২৬টি বাস চলে রজব আলীর। তিনি জানান, বাস বন্ধ থাকায় তিনদিনে তার কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা লোকসান হবে। আবার ২৬টি বাসের চালক ও হেলপাররা যেহেতু দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন তাদেরও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে।
তবে বিভাগীয় পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাফকাত মঞ্জুর বিপ্লব জানান, তাদের দাবি আদায়ের জন্য এ ধরনের লোকসান মেনে নিতেই হবে।
এদিকে বিএনপি নেতাদের দাবি, অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতো রাজশাহীর গণসমাবেশেও মানুষকে আসতে বাধা দিতে এই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গণসমাবেশ কমিটির সমন্বয়ক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, 'সমাবেশে যেন নেতাকর্মীরা আসতে না পারেন, সেজন্য রাজশাহী বিভাগে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। ধর্মঘট দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের আটকে রাখা যাবে না। যেকোনো মূল্যে এই গণসমাবেশ সফল করা হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাফকাত মঞ্জুর বলেন, 'গণসমাবেশের সঙ্গে তাদের ডাকা ধর্মঘটের কোনো যোগসূত্র নেই। বিষয়টি "কাকতালীয়"। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের এই কর্মসূচির কোনো সম্পৃক্ততা নেই।'
আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ কর্মসূচি
এদিকে বিএনপি যাতে সমাবেশের নামে কোনো ধরনের অরাজকতা তৈরি করতে না পারে সেজন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সমাবেশের নামে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড তথা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে কোনো অশোভন মন্তব্য এবং রাজশাহীর জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধন করলে তা বরদাশত করা হবে না।'
রাজশাহী মহানগরের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় কুমারপাড়াস্থ দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, 'আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে তারা ইতিমধ্যেই সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, যখনই বাংলাদেশে নির্বাচন এগিয়ে আসে ঠিক তখনই বিএনপি নামক সংগঠনটি সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।'
তিনি আরো বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হওয়ার সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। নির্বাচনে বিএনপি না এলে নির্বাচন কারো জন্য থেমে থাকবে না।