৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে আ.লীগের মহাসমাবেশ: প্রস্তুত হচ্ছে মঞ্চ, চার লাখ জনসমাগমের টার্গেট
'৪ ডিসেম্বর বিকেলবেলা/ পলোগ্রাউন্ডে জমবে মেলা/ প্রধানমন্ত্রীর জনসভায়/ চাটগাঁবাসী আয় ছুটে আয়'-খোলা ট্রাকে ছন্দে ছন্দে কথাগুলো বলে চলেছেন এক ছাত্রলীগ কর্মী। তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন আরও কয়েকজন। আগামী ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরের পলোগ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভার অবিরাম প্রচারণা চলছে এভাবেই। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে চট্টগ্রামে এখন সাজ সাজ রব।
পলোগ্রাউন্ডের জনসভা থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে চায় আওয়ামী লীগ। এই সমাবেশ থেকে বিএনপির সমাবেশেরও জবাব দিতে চাইছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ লক্ষ্যে পুরো সপ্তাহ জুড়েই চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
বিএনপিকে কঠিন বার্তা দিতে চায় আ.লীগ
আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। বিএনপির সমাবেশ ঘিরে এরইমধ্যে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দুই দলের এই মুখোমুখি অবস্থার এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের মহা সমাবেশ।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, 'পলোগ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা থেকে স্থানীয় ও জাতীয় বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আসবে। প্রধানমন্ত্রী নৌকায় ভোট চাইবেন, একই সঙ্গে সমাবেশের নামে বিএনপি সকল নৈরাজ্যের জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী।'
গত ১২ অক্টোবর পলোগ্রাউন্ড মাঠেই জনসভা করে বিভাগীয় রাজনৈতিক সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে দুই প্রধান দলের নেতারাই ওই সমাবেশের জনসমাগম নিয়ে নামেন বাকযুদ্ধে। নিজেদের সাম্প্রতিক সমাবেশে জনসমাগম দেখিয়ে বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, জনগণ এই সরকারের পতন চাইছে।
অপরদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে পলোগ্রাউন্ডে আওয়ামী লীগের সমাবেশ দেখার দাওয়াত দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
চট্টগ্রামে সাজ সাজ রব
কোথাও সড়কের আইল্যান্ডে শোভা পাচ্ছে বিশাল নৌকা। চলছে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, ট্রাকে প্রচারণা চালানো, ঢোলের বাদ্য, দেশাত্মবোধক গান।
এদিকে সভা উপলক্ষে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সড়কই ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এসব পোস্টারে নগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে পদপ্রত্যাশীদের আধিক্য দেখা গেছে। লোক সমাগম বাড়াতে নেতাকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে লোকজনকে জনসভায় আসতে উদ্বুদ্ধ করছেন। একই সমান্তরালে প্রচারণা ও সভা করছেন নগর, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও।
সমাবেশের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, মহানগর-উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ জনসভায় নগরের ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ড থেকে দুই লাখের বেশি মানুষ সমাবেশে যোগদান করবে। একেকটি ওয়ার্ড থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ আসবে। এছাড়া যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, তাঁতী লীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সমর্থকরা যোগ দিবেন জনসভায়।
ধর্মঘট নেই, ২০০ বাস-ট্রাক ভরে কর্মী আনার লক্ষ্য আওয়ামী লীগের
গত ১২ অক্টোবর পলোগ্রাউন্ড মাঠেই জনসভা করে বিভাগীয় রাজনৈতিক সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের সর্বত্র যেখানেই বিএনপি সমাবেশ করেছে, সেখানে পরিবহন মালিকরা সমাবেশের আগে বিভিন্ন দাবীতে ধর্মঘট পালন করেন। কিন্তু চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের সমাবেশের আগে কোনো ধর্মঘট নেই বলে জানিয়েছেন পরিবহন নেতারা। সমাবেশ সফল করতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৪ ডিসেম্বর লোকজন আনতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাড়ি বুকিং দেওয়ার কথা জানিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতারা।
চট্টগ্রাম পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু বলেন, '৪ ডিসেম্বর বা আগে-পরে চট্টগ্রামে ধর্মঘটের কোনো কর্মসূচি নেই।'
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম বলেন, ১৫ উপজেলা থেকে চার লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটানো হবে। জনসভায় যোগ দিতে ইতোমধ্যেই অন্তত ২০০ বাস-ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। সন্দ্বীপ থেকে লঞ্চ, স্পিডবোটে সমর্থকরা আসবেন। নেতাকর্মীদের অনেকে শহরের বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার, আবাসিক হোটেলে রাতযাপন করবেন। তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।
নৌকার আদলে ১৬০ ফুট মঞ্চ
নগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠে জোরেশোরে চলছে মঞ্চ নির্মাণের কাজ। নৌকার আদলে ১৬০ ফুটের মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে। মঞ্চের উচ্চতা হবে সাত ফুট। মঞ্চে একসাথে বসতে পারবেন ২০০ অতিথি। এছাড়া মঞ্চের সামনে মুক্তিযোদ্ধা, ভিআইপি ও নারীদের বসার জন্য পৃথক প্যান্ডেল তৈরি করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, পৌনে ৫ লাখ বর্গফুটের পলোগ্রাউন্ড ময়দানের শেষপ্রান্তে ১৬০ ফুট লম্বা নৌকার আদলে তৈরি হচ্ছে মঞ্চ। প্রবেশপথ থেকে জনসভাস্থলে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে সীমানা। ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে।
মঞ্চ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা সাহাবুদ্দিন ডেকোরেটর্সের মালিক সাহাবউদ্দিন বলেন, '১৯৭৫ সাল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্তত এক হাজার জনসভার মঞ্চ করেছি। প্রধানমন্ত্রী যখন এই পলোগ্রাউন্ডে সর্বশেষ জনসভা করেন, সেই মঞ্চও আমাদের করা। তবে এবারের মতো বড় মঞ্চ চট্টগ্রামে আগে কখনো আমরা করিনি।'
জনসভার স্থান থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারে পলোগ্রাউন্ড ও আশেপাশের এলাকায় লাগানোর জন্য ঢাকা থেকে আসছে বিখ্যাত মাইক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কলরেডির ১৫০টি মাইক। মঞ্চের মাঝখানে ৮০ ফুটের এলইডি লাগানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেখার জন্য ভেতরে-বাইরে সাত স্থানে বড় এলইডি স্ক্রিন লাগানো হবে। সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে সমাবেশস্থলের আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকা।
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শোডাউনের প্রস্তুতি
চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় মন্ত্রী, এমপি, হুইপসহ নেতাকর্মীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বড় ধরনের শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নগরী ও নগরীর বাইরে সংসদীয় আসনগুলো থেকে কে কার চেয়ে বেশি লোকের উপস্থিতি বা সমাগম ঘটাতে পারবেন তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্রের কাছে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে চান তারা।
পটিয়ার এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নেতাকর্মীরা লাল টুপি আর লাল গেঞ্জি পরে ভোর ৬টায় রেলস্টেশনে ২০ হাজারের অধিক কর্মী নিয়ে জনসভার উদ্দেশ্যে অবস্থান নেবেন বলে জানান পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এজাজ চৌধুরী।
অপরদিকে রাউজানের এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী ২০ হাজার কর্মী নিয়ে রাউজান থেকে সবুজ টুপি আর সবুজ গেঞ্জি পরে ভোর ৬টায় সিআরবিতে অবস্থান নেবেন।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নির্বাচনী এলাকা আনোয়ারা–কর্ণফুলী থেকে অন্তত ৪০ হাজার নেতাকর্মী জনসভায় উপস্থিত থাকবেন জানান আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়া থেকেও ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
এমপিরা ছাড়াও জনসভাকে ঘিরে রীতিমত শোডাউনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। সংগঠনের নেতারা নিজ নিজ পক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড, তোরণ বানিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
জনসভার নিরাপত্তায় থাকবে ৭৫০০ পুলিশ
পুলিশ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচিকে ঘিরে নগরজুড়ে সাড়ে সাত হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমন্বয় করে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স। তাদের তত্ত্বাবধানে এবং পরামর্শক্রমে পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন থাকবে। সিএমপিতে আমাদের ছয় হাজারের মতো অফিসার-ফোর্স আছে। এর অধিকাংশইবিভিন্নভাবে সিকিউরিটির সাথে সংযুক্ত থাকবে। বাইরে থেকে দেড় হাজার ফোর্স সিএমপিতে যুক্ত থাকবে।'
'এসএসএফ, পিজিএফ, সাদা পোশাকের পুলিশ, ইউনিফর্মের পুলিশ, গোয়েন্দা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। নিরাপত্তায় আর্চওয়ে, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, ড্রোনসহ প্রযুক্তিগত সকল কিছু যুক্ত থাকবে। প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিচ্ছি। শুধু পলোগ্রাউন্ডেই পুলিশ থাকবে না, পুরো শহর একটি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হবে।'