চাকরির নিরাপত্তার জন্য নিচুস্তরের সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন অনেক গ্র্যাজুয়েট
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন ৬২১টি নিচুস্তরের এমএলএসএস পদের বিপরীতে সাক্ষাৎকারের জন্য ১০ হাজার প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে। এই ১০ হাজার প্রার্থীর কমপক্ষে ৮০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট, যদিও এই ১৭তম গ্রেডের পদের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা এসএসসি পাশ।
অবাক করা বিষয় হলো, শুধু এক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও চিত্রটি একই রকমের।
নিয়োগদাতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৬তম গ্রেড থেকে এসএসসি এবং ১৪তম গ্রেড থেকে এইচএসসি ন্যূনতম যোগ্যতা চাওয়া হয়। তবে নিচুসারির সব পদেই গ্র্যাজুয়েট প্রার্থীদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তারা আরও জানান, এই সমস্যার মূল কারণ দেশের চাকরির বাজারের অবস্থা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে কথা বলার সময় অনেক চাকরিপ্রার্থী জানান, দেশের চাকরির বাজারে সংকট দেখা দেওয়ায় তারা নিচু সারির পদে আবেদন করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে এটাও বলেন যে, নিচু সারির পদ হওয়া সত্ত্বেও চাকরির নিরাপত্তা এবং আগের তুলনায় বেশি বেতন হওয়ায় গ্র্যাজুয়েটরা এদিকে ঝুঁকছেন।
২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের সবাই দেশের বিভিন্ন পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন।
তাদের মধ্যে একজন বরিশালের কামরুল হাসান (ছদ্মনাম)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন দক্ষ ও জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ হয়ে বের হওয়ার জন্য। একইসাথে একটি প্রথম সারির সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির স্বপ্ন দীর্ঘদিন ধরে ছিল তার, যার মাধ্যমে তিনি সম্মান ও স্বচ্ছলতার সাথে দিন কাটাতে পারবেন।
কিন্তু তার স্বপ্নের চাকরিগুলো পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয়ে হতাশ কামরুল শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টের অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি নেন।
কামরুল জানান, "আমার দুর্ভাগ্য যে আমার গ্র্যাজুয়েশনের পরও আমাকে একজন অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। আমি স্বীকার করি যে আমি হয়তো অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারতাম, কিন্তু একই সাথে এই রাষ্ট্র আমাদের দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করতে না পারার ব্যর্থতা অস্বীকার করতে পারে না।"
এই বছরের ১৬ নভেম্বর এডুকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ১৬ জন ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানেও নিয়োগপ্রাপ্তদের সবাই পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন।
তাদের মধ্যে একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট টিবিএসকে জানান যে, তিনি অন্যান্য সরকারি চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে গিয়েছেন, তাই তিনি যদি এখানে না ঢোকেন তবে তিনি আর কোনো সরকারি চাকরি পাবেন না।
তিনি আরও জানান, "আমি বেসরকারি চাকরি করতে পারতাম, কিন্তু সেগুলো অনিশ্চিত। এটা সত্যি যে কিছু মানুষ বেসরকারি চাকরি করেও বেশ ভালো অবস্থানে আছেন, কিন্তু বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরিজীবিরাই চাকরির নিরাপত্তায় ভোগেন এবং কম বেতন পান। সবকিছু বিবেচনা করে আমি ১৬তম গ্রেডের এই চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
এডুকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. আসাদুজ্জামান টিবিএসকে জানান যে তার বিভাগ নভেম্বর মাসে ৪২৭ জনকে নিয়োগ দিয়েছে, যার বেশিরভাগই ১৬তম গ্রেডে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮৫ শতাংশ নিয়োগপ্রাপ্তেরই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি রয়েছে। "চাকরির ঘাটতি প্রচণ্ড, যে কারণে ৪২৭টি পদের বিপরীতে সাড়ে ছয় লক্ষ প্রার্থী আবেদন করেছে। আমি এর আগে কখনো এরকম অবস্থা দেখিনি," যোগ করেন তিনি।
জনগণের টাকা অপচয়!
বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের এই নিচুস্তরের সরকারি চাকরির পেছনে ছোটার প্রবণতা তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্র যা আশা করে তা থেকে বঞ্চিত করে, বিশেষ করে তাদের শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্রের যে বিশাল বিনিয়োগ হয়েছে তা যদি তুলনা করা হয়- মতামত দেন নিয়োগকর্তারা, যাদের মধ্যে রয়েছেন বড় বড় সরকারি কর্মকর্তারা। তারা একে অ্যাখ্যা দিয়েছেন জনগণের টাকার অপচয় হিসেবে।
সূত্র অনুযায়ী, সরকার প্রতিবছর একজন ছাত্রের পেছনে গড়ে দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮ লক্ষ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর প্রশাসনিক পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান জানান, উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত উঁচু মানের চাকরির জন্য দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশি গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক। তিনি জানান, "তাৎক্ষণিকভাবে চাকরির বাজার সম্প্রসারণের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিৎ উঁচু পদে কাজের জন্য দক্ষ ও ভালো গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে মনোযোগী হওয়া।"
সরকারি চাকরির সংকট, অতিরিক্ত গ্র্যাজুয়েট
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালের ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় ২০৫২টি পদের বিপরীতে পরীক্ষা দিয়েছে ২ লক্ষ ২১ হাজার ৫৭৫ জন প্রার্থী। সাত বছর পর প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৭৫ হাজারে, বিসিএস পরীক্ষার ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯ লক্ষ ১৩ হাজার সরকারি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ২ লক্ষ ৩৯ হাজার পদ প্রথম সারির, ২ লক্ষ ১০ হাজার দ্বিতীয় সারির, ১১ লক্ষ ৯০ হাজার তৃতীয় সারির এবং ৩ লক্ষ ৫৩ হাজার চতুর্থ সারির।
বর্তমানে ৩ লাখ ৫৮ হাজার পদ খালি রয়েছে। তবে প্রতি বছর দেশজুড়ে ৮ লাখ ছাত্র তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ থেকে জানা যায়, উচ্চতর শিক্ষা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ বেকার বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ তাদের জরিপ থেকে দেখতে পায় দেশের ৬৬ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটই বেকার থেকে যায় যারা সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত কলেজ থেকে তাদের উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছে। উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়া এই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২১৫৪টি।
বেসরকারি খাতের বাজে অবস্থা
বেসরকারি খাতেও চাকরির সংকট চলছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এ অবস্থা আরও বাজে দিকে মোড় নিয়েছে। গার্মেন্টস শিল্প থেকে আইসিটি, খাবার পর্যন্ত সবধরনের খাত তাদের প্রচুর কর্মীকে ছাঁটাই করেছে, নতুন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়াও বন্ধ রেখেছে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করা মো. কাওসার আহমেদ টিবিএসকে জানান যে, তিনি ২০১৯ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। তারপর থেকে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি ভালো চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
"বড় প্রতিষ্ঠানগুলো উঁচুসারির পদগুলোতে নিয়োগ করা বন্ধ করে দিয়েছে যদিও তারা মাঝেমধ্যে নিচু সারির পদগুলোতে নিয়োগ দেয়। অন্যদিকে মাঝারি বা ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির সুযোগ থাকলেও সেগুলোর বেতন খুবই কম। তাই, আমি একটি ভালো চাকরির জন্য অপেক্ষা করছি।"