ডলার সংকটে আটকে আছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানি বিল ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ
১,৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকারী বাংলাদেশ-চীনের যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (পিভিটি) লিমিটেড কয়লা আমদানি বিল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে ডলারের সংস্থান করতে হিমশিম খাচ্ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে আসা নথির তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে অর্থপ্রদানের কয়েকটি ডেডলাইন মিস করেছে। চলতি মাসে তাদের জরুরি ভিত্তিতে ৩৮৭.৩৯ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
এর মধ্যে ১১৪ মিলিয়ন ডলার লাগবে একটি ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থপ্রদানের জন্য। এই কিস্তি ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে শোধ করার কথা থাকলেও কোম্পানিটি ডেডলাইন মিস করেছে।
নথি অনুসারে, কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে দেশ খেলাপি হতে পারে। এতে কর্তৃপক্ষ পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য ঋণ সহায়তা পেতে ঋণদাতা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অভ চায়নার কাছে অযোগ্য হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম অবশ্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কিস্তি পরিশোধের জন্য তাদের হাতে পুরো ডিসেম্বর মাস সময় আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক বিলটি নিষ্পত্তি করছে বলেও জানান তিনি।
তবে সোনালী ব্যাংকের সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, ৮ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) ব্যাংকিংয়ের সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়নি।
শেষ মুহূর্তের এই তাড়াহুড়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খোরশেদুল আলম বলেন, 'আমরা কিস্তি শোধ করতাম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংকটি কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে সহায়তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই অ্যাকাউন্টটি সোনালী ব্যাংকে স্থানান্তর করতে হয়েছে। এতে কিছুটা সময় লেগে গেছে।'
প্রয়োজনীয় তারল্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তাও চেয়েছে।
ঋণ পরিশোধ
বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)-এর যৌথ উদ্যোগে গঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি।
যৌথ উদ্যোগের এ কোম্পানি ২.৪৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।
মোট ব্যয়ের মধ্যে ঋণ হিসেবে ১.৯৮৪ বিলিয়ন ডলারের জোগান দিয়েছে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অভ চায়না। বাকি ০.৪৯৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে।
দাতার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ঋণের মেয়াদ ১৫ বছর, গ্রেস পিরিয়ড চার বছর। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি ঋণের আসল ও সুদ ২৩টি অর্ধ-বার্ষিক কিস্তিতে ২.৯৮ শতাংশ লাইবর প্লাস সুদহারে পরিশোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কোম্পানিটি ইতোমধ্যে তিন কিস্তিতে ২০১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধও করেছে।
ঋণদাতা ১১৪ মিলিয়ন ডলারের একটি চালান ইস্যু করেছে, যা ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু সোনালী ব্যাংককে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার এই অর্থ পরিশোধ করতে বললে ব্যাংক জানায়, তারা এত বড় অঙ্কের মার্কিন ডলার পরিশোধের অবস্থায় নেই।
সোনালী ব্যাংকের উত্তর পাওয়ার পর কোম্পানিটি ১ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে একটি লিখিত অনু্রোধ পাঠায়। সেখানে অর্থ বিভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টকে প্রয়োজনীয় ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিময় হারে আগামী ৮ ডিসেম্বরের আগে সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে সাহায্য করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, 'অর্থ মন্ত্রণালয় এ ঋণ পরিশোধ করার লক্ষ্যে ঋণদাতাদের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের একটি সার্বভৌম গ্যারান্টি ইস্যু করেছে। ৪র্থ কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে দেশ খেলাপি হতে পারে।'
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের অর্থায়নও একই ঋণদাতার করার কথা। চিঠিতে এ বিষয়টি নিয়েও নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, যথাসময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে, প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের কাজের ঋণের অর্থায়ন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এর আগে গত ১৩ নভেম্বরও কোম্পানিটি ঋণ পরিশোধ ও কয়লা আমদানি-সংক্রান্ত অর্থপ্রদানের জন্য ডলার বরাদ্দ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট ও বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেয় ।
বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি তাদের চিঠিতে লেখে, বাংলাদেশ ব্যাংকই একমাত্র উৎস যা তাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার তারল্যের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর সক্ষমতা রাখে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বকেয়া কয়লা আমদানি বিল
দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ১,৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটির জন্য কয়লা আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালানোর জন্য বছরে প্রায় ৪ মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ারকে কোম্পানিকে প্রতি মাসে ৭০ মিলিয়ন থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ১২-১৩টি এলসি খুলতে হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি বলেছে, ঋণের কিস্তি ছাড়াও নভেম্বর পর্যন্ত তাদের বকেয়া কয়লা আমদানি বিল ছিল ৯৪.৮৪ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়াও, চিঠি অনুসারে, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কয়লা আমদানি এবং ফ্রেইট বিল প্রদানের জন্য কোম্পানিটির যথাক্রমে ৮৬.৮৮ মিলিয়ন ডলার এবং ৯১.৬৭ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।
তবে খোরশেদুল আলম বলেন, কয়লা আমদানির বিল পরিশোধে এই বিলম্ব হওয়ায় কোম্পানি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ তারা রপ্তানিকারককে ছয় মাস দেরিতে (ডেফার্ড পেমেন্ট) অর্থ নিয়ে জ্বালানি সরবরাহে রাজি করাতে পেরেছেন।