নিত্যপণ্য আমদানির ঘাটতি পূরণে এগিয়ে এসেছে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো
আমদানিতে কিছু প্রতিষ্ঠানের মনোপলির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছোট ও মাঝারি আমদানিকারকরা আগে যেখানে এলসি খুলতেই হিমশিম খেতেন, সেখানে গত অক্টোবর থেকে তারা ভোগ্যপণ্যের সরবরাহের ঘাটতি পূরণে নিজেদের আমদানি অনেকটাই বাড়াতে পারছেন।
এ ধরনের অন্তত ৩০-৪০টি প্রতিষ্ঠান যারা আগে সীমিত পরিসরে আমদানি করতো বা একেবারেই আমদানি বন্ধ করেছিল— এখন তারা ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ফিরেছে বিশেষত রমজানকে সামনে রেখে।
চিনি, ভোজ্য তেল, ছোলা এবং ডালের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ যাতে নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য এসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সক্রিয়ভাবে ভোগ্যপণ্য আমদানি করছে। এসব পণ্যের বাজার আগে বছরের পর বছর ধরে আধিপত্য করে এসেছে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ।
গত বছরে কার্যক্রম শুরু করা আবুল খায়ের গ্রুপের স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস এবছরের জুলাইয়ে ১ হাজার ৯৯২ টন ক্রুড (অশোধিত) সয়াবিন আমদানি করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটি আগস্টে আমদানি করেছে আগস্টে ২ হাজার ৫৭৯ টন, সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ৩৭২ টন এবং অক্টোবরে ১ হাজার ৪৮৬ মেট্রিক টন ক্রুড সয়াবিন।
একই সময়ে গত বছর ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মাত্র ১ হাজার ৮১ টন সয়াবিন আমদানি করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানান, ভোগ্যপণ্যের বাজার দখল করতে আবুল খায়ের গ্রুপ ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদাসের একটি এবং এসএ গ্রুপের তিনটিসহ – মোট চারটি ভোজ্যতেল পরিশোধনাগার কিনে নিয়েছে।
স্মাইল ফুড প্রোডাক্টের পরিচালক মাহবুব কামাল বলেন, আমরা নতুন করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছি।'
ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যাংকখাতে এস আলম গ্রুপের প্রভাব অনেক ব্যাংককে বাধ্য করেছিল এলসি খোলায় তাদের অগ্রাধিকার দিতে, তবে গত ৫ আগস্টের পর থেকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে শুরু করে।
আমদানিতে এস আলমের পতনের চিত্র উঠে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যেও। গত জুলাইয়ে ২৫ হাজার ৮০ টন এবং আগস্টে ৩৫ হাজার ৪২০ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে এস আলম রিফাইনড সুগার। কিন্তু, এরপর থেকে কোনো চিনি আমদানি করতে পারেনি। একইভাবে গত জুলাই মাসে ১৮ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন ক্রুড সয়াবিন তেল আমদানি করলেও— তারপর থেকে পণ্যটি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।
ফলে কাঁচামাল সংকটে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে গ্রুপটির চিনি, তেল ও ইস্পাত কারখানার উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
দেশের শীর্ষ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ডিজিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, কোনো একটি গ্রুপের কারখানা বা আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে তাতে দেশের বাজারে প্রভাব পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। এরমধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপের মতো আরেকটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী কয়েক বছর বিরতির পরে দেশের নিত্যপণ্যের চাহিদা পূরণে এগিয়ে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আরো এলসি ও আমদানি
গত ৫-৭ বছর ভোগ্যপণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছিল আবুল খায়ের গ্রুপ। তবে গত চার মাসে আবারো স্বরূপে ফিরেছে ভোগ্যপণ্য আমদানির দীর্ঘদিনের জায়ান্ট আবুল খায়ের।
গ্রুপটির আমদানি ঋণপত্র খোলা ব্যাংকগুলোর তথ্যমেতে, গত তিন-চার মাসে গম ও তেলসহ— নিত্যপণ্যের বড় একটি অংশ আমদানি করেছে আবুল খায়ের গ্রুপ। আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে গ্রুপটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি আরো বাড়িয়েছে।
এনসিসি ব্যাংকের জোনাল হেড (চট্টগ্রাম) আলী তারেক পারভেজ বলেন, গত বছরের শেষ দিকে নুতন করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে আসে আবুল খায়ের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান 'স্মাইল ফুড প্রোডাক্ট'। তবে আগস্টের পর থেকে গ্রুপটির আমদানির যেই চিত্র— তা নিঃসন্দেহে দেশের অন্যান্য আমদানিকারকদের ছাড়িয়ে গেছে।
খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রেজা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম বলেন, আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছি। যা কয়েকটি ধাপে রমজানের আগে বাজারে প্রবেশ করবে। কিন্তু গত কয়েক বছর 'বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর' কারণে আমরা পণ্য আমদানি করতে পারিনি। ওই সময় ব্যাংকগুলো আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের পাত্তা দিতো না।
সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি বাড়ানো খাতুনগঞ্জের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে– সিটি কমোডিটিজ, মেসার্স কলি ট্রেডার্স, জামান এন্টারপ্রাইজ, খাতুনগঞ্জ ট্রেডিং, দীন কোম্পানি, এএম ট্রেডিং, শ্রী মাতৃ ভান্ডার এবং খান এন্ড সন্স-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া ঢাকার ক্রাউন গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, উত্তরবঙ্গের নাবিল গ্রুপ এবং যশোরের শেখ ব্রাদার্সের মতো প্রতিষ্ঠানও তাদের আমদানি বাড়িয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ব্রাঞ্চে ছোট ও মাঝারি মানের ও প্রকৃত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পণ্য আমদানি বেড়েছে। তিনি বলেন, 'সর্বশেষ গত পাঁচ-সাত বছর ছোট কিংবা মাঝারি আমদানিকারকদের পণ্য আমদানি অনেকটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ কিছু ব্যাংক দেশের কয়েকটি শিল্পগ্রুপকে কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই আমদানি সুবিধা দিত। যেই কারণে গ্রুপগুলো মনোপলি বিজনেস করতে। এতে প্রকৃত আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা চাপে পড়তো।'
শ্রী মাতৃ ভান্ডারের মালিক হরধন নাগ বলেন, 'গত দুই-তিন মাস ধরে আমরা আগের মতো আমদানি শুরু করেছি। এই সময়ের মধ্যে আমরা ৪ হাজার টন সাদা মটর এবং ২ হাজার টন ছোলা আমদানি করেছি। আসন্ন রমজানের আগে আমরা কমপক্ষে আরও ৬ হাজার টন মটর এবং ৪ হাজার টন ছোলা আমদানি করার প্রক্রিয়া চলছে।'
তিনি আরও জানান, শ্রী মাতৃ ভান্ডার আগস্ট থেকে ছোলা আমদানির জন্য ৪৩ লাখ ডলার মূল্যের এলসি খুলেছে। এই সময়ের মধ্যে তারা ৪১ লাখ ডলার মূল্যের মটর আমদানি করতে পারবেন।
খাতুনগঞ্জের কিং ট্রেডার্সের মালিক পরিতোষ দে বলেন, গত তিন-চার বছর ধরে আমার প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। তবে সম্প্রতি আমরা রমজান মাসে সরবরাহ নিশ্চিত করতে ছোলা আমদানির জন্য ৭০ লাখ ডলার, মটর আমদানির জন্য ৪০ লাখ ডলার এবং ডাল আমদানির জন্য ৫০ লাখ ডলারের এলসি খুলেছি।
সিটি কমোডিটিসের মালিক রাশেদ আলী বলেন, '২০২২ সালে আমি ৩ লাখ ২৩ ডলার ডলার দামের ছোলা আমদানির জন্য এলসি খুলতে বেশি কয়েকটি ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু, তাদের কেউই এলসি জারি করেনি। যার ফলে আমাকে আমদানি কমাতে হয়েছিল। তবে আমি এখন ইসলামী ব্যাংকের আসকার দীঘি শাখার মাধ্যমে গম, ছোলা, মটর, ডাল এবং ফল আমদানি করছি।'
এস আলমের কারখানা বন্ধের কোনো প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের বাজারে?
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে এস আলমের কারখানাগুলো অক্টোবরের মধ্যে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এখন আনুষ্ঠানিক বন্ধ ঘোষণায় বাজারে প্রভাব পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
এরমধ্যে গত ২৪ আগস্ট আটটি চিনি, ইস্পাত ও ব্যাগ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। গ্রুপটির কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে না পারার কারণেই তারা এসব কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
বন্ধ ঘোষণা করা কারখানাগুলো হলো এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস আলম ব্যাগ, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড, ইনফিনিটি সিআর স্ট্রিপস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইস্পাত খাতের এনওএফ, চেমন ইস্পাত, এস আলম স্টিল এবং গ্যালকো।
টিবিএস এর অনুসন্ধানে উঠে আসে- আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধের ঘোষণা না দিলেও নভেম্বর থেকেই গ্রুপটির ভোজ্যতেল কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
বাজারে একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে এস আলমের পতনে বাজারে পণ্য সংকট ও দাম বাড়ার যেসব আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, আমদানি ব্যবসার সংশ্লিষ্টরা তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও জানান।
তাই ৫ আগস্টের পর গ্রুপটির আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুরুর দিকে পণ্যের কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন অনেকটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। তাই বাজারের প্রকৃত আমদানিকারকদের পণ্য আমদানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে এবং ইতোমধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমে এসেছে বলে জানান তাঁরা।
মেঘনা গ্রুপের ডিজিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, ইতোমধ্যে সরকার নিত্য প্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের শুল্ক-কর কমিয়ে এনেছে। ব্যাংকগুলো নিত্যপণ্য আমদানিতে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিচ্ছে। এতে ইতোমধ্যে পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে এবং বাজারও স্থিতিশীল হয়েছে। 'এমনকি রমজানেও পণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই' – বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
এস আলম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার আশীষ কুমার নাথ বলেন, আগস্টের পর কাঁচামাল সংকটে কারখানাগুলো উৎপাদন একের পর এক বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও ব্যাংকগুলোর সাথে দর কষাকষি করে ঋণপত্র খুলতে পারে কি না— তা চেষ্টা করতে এবং আগের আমদানিকৃত ও প্রস্তুত পণ্য বিক্রি করতে কারখানাগুলো এতদিন খোলা রাখা হয়েছিল। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ রেখে কারখানা খোলা রাখলে শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হচ্ছে। তাই কাঁচামাল আমদানির কোনো সম্ভাবনা না থাকায় লোকসান কমাতে আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এস আলম গ্রুপ থেকে চাকুরি হারানো এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের অন্যান্য বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মতো এস আলমের শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান নেই। তাদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আমদানি নির্ভর-ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের মতো। যেমন গ্রুপটির বড় বিনিয়োগ তেল, চিনি ও ইস্পাত খাতে। এসব প্রতিষ্ঠান আমদানি শেষে পরিশোধন করে কিংবা ইস্পাতের পুরুত্ব পরিবর্তন করে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে দেয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি কর্মীর প্রয়োজন হয় না।