কুকুরপ্রতি ৫০০ টাকা কর: ঢাকা দক্ষিণের আধখেঁচড়া কর নিয়ম!
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) কোনো বাসিন্দা কুকুর পালন করলে প্রতি কুকুরের জন্য বার্ষিক কর দিতে হবে ৫০০ টাকা। এছাড়া ঘোড়া ও হরিণ পালনে প্রতিটির জন্য কর দিতে হবে ১ হাজার টাকা। যদিও এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশন করের এ অর্থ দিয়ে কী করবে, তা এখনও অস্পষ্ট।
'সিটি কর্পোরেশন আদর্শ কর তফসিল, ২০১৬'-এর গণবিজ্ঞপ্তি অনুসারে, প্রতিটি পোষা জন্তুর জন্য বার্ষিক কর দিতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণের ভেটেরিনারি অফিসার (জোন-২ ও ৬) ডা. একেএম সালেহ রহমান জানান, দক্ষিণ সিটিতে আগে পোষা জন্তু নিবন্ধনের নিয়ম ছিল না। নিয়মটি কিছুদিন আগে চালু হয়েছে।
তিনি জানান, যারা নিবন্ধনের আওতায় আসবে তাদের পোষা জন্তুকে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
কুকুরের ক্ষেত্রে মালিক লাইসেন্স নিলে সিটি কর্পোরেশন থেকে ডাক্তারের সুবিধা পাবেন।
অবশ্য ডাক্তার বিনামূল্যে দেখানো যাবে কি না, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।
তিনি বলেন, 'পোষা কুকুরের ওপর আরোপ করা কর পরিশোধ করলেই লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। উন্নত বিশ্বের মতো দক্ষিণ সিটিতেও পোষা জন্তুর জরিপসহ ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা হবে।'
ঢাকা দক্ষিণের ডেপুটি চিফ রেভেনিউ অফিসার শাহজাহান আলী টিবিএসকে বলেন, সিটি কর্পোরেশন আদর্শ কর তফসিল অনুযায়ী কর্পোরেশনের আওতাধীন প্রতিটি পোষা জন্তু (কুকুর, হরিণ ও ঘোড়া) পালনের ক্ষেত্রে কর নির্ধারিত রয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এর আগে কখনও এক্ষেত্রে কর আদায় হয়নি। চলতি অর্থবছরেই প্রথম পোষা জন্তুর ক্ষেত্রে কর আদায় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৭টি পোষা প্রাণীর মালিক কর জমা দিয়েছেন বলে জানান শাহজাহান আলী।
বিজ্ঞপ্তিতে এসব পোষা জন্তুর মালিকদেরকে স্ব স্ব অঞ্চলের রাজস্ব বিভাগের বিবিধ আদায় শাখায় উল্লিখিত হারে কর এবং এ করের উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রদান করতে অনুরোধ করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ সিটির আওতায় ১২৮টি পোষা কুকুর, ১৪৫টি হরিণ এবং ৪৬টি ঘোড়া রয়েছে।
সিটি কর্পোরেশন ইতিমধ্যে এসব পোষা জন্তুর মালিকদের চিঠি দিয়ে করের বিষয়টি অবহিত করেছে।
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির এমন সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলছেন পশুপ্রেমী ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত প্রাণী পুস্তে মানুষকে নিরুৎসাহিত করবে। উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করে শুধু কর আরোপ করলে মানুষ প্রাণী পুষতে আগ্রহ হারাবে—এমনটা বলছেন তারা।
পুরান ঢাকার শিপন হোসেন প্রায় ৫ বছর ধরে কুকুর ও বিড়াল পুষছেন। এখন তার তিনটি কুকুর ও ২টি বিড়াল আছে বাসায়। পোষা জন্তু পালনের ক্ষেত্রে কর দিতে শুনে তিনি রীতিমতো চমকে গেলেন তিনি।
শিপন টিবিএসকে বলেন, কেউ পোষা জন্তু পালন করলে যেখানে সিটি কর্পোরেশনের উৎসাহ দিতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেখানে উল্টো কর আরোপ করে পশুপ্রেমীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
'এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক না। আমার তিনটি কুকুরের জন্য বছরে ১,৫০০ টাকা দিতে হবে—সেটা হয়তো টাকার পরিমাণে বড় নয়, তবে আমি কেন নিজ খরচে কুকুর পালন করে সিটি কর্পোরেশনকে কর দেব? সিটি কর্পোরেশনের এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত,' বলেন তিনি।
এএলবি অ্যানিম্যাল শেল্টার কুকুর পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে। তাদের কাছে প্রায় ৭০টির মতো কুকুর রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসা দিচ্ছেন এখোনের স্বেচ্ছাসেবকরা।
এএলবি-র প্রতিষ্ঠাতা দীপান্বিতা হৃদি কর আরোপের বিষয়টিকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, 'আমরা ভলান্টিয়ারি কাজ করে বিভিন্ন স্থান থেকে আহত কুকুর এনে চিকিৎসা শেষে পুনর্বাসন করি। আমাদের এখান থেকে অনেকেই কুকুরের চিকিৎসা করাতে আসেন। প্রতিটি কুকুরের জন্য যদি বছরে ৫০০ টাকা দিতে হয় তবে অনেকেই আগ্রহী হবে না কুকুর পালনে। এছাড়া আমাদের এখানের এতগুলো কুকুরের জন্য কীভাবে কর দেব?'
রবিনহুড দ্য অ্যানিম্যাল রেসকিউয়ার-এর ক্লিনিক্যাল অফিসার মনোয়ারা আখতার মুনিয়া টিবিএসকে বলেন, রাজধানীতে এমনিতেই প্রাণী উদ্ধারকারীর সংখ্যা খুবই কম।
'এরপরে যদি পোষা প্রাণীর ওপর কর আরোপ করে তবে অনেকেই প্রাণী পোষা বন্ধ করে দেবে। রাস্তায় মার খেয়ে পড়ে থাকা কুকুরগুলোকে তখন আর কেউ বাসায় নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে পালন করবে না। উন্নত বিশ্বের মতো চিন্তা করে কর আরোপ করলেই সবকিছুর সমাধান হবে না, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বেশি হবে,' বলেন তিনি।
ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, নগরে পোষা প্রাণীর একটি ডাটাবেইজ থাকা প্রয়োজন। এজন্য এককালীন একটি রেজিস্ট্রেশন করা যায় এবং তখন একটি ফি নিতে পারে। কিন্তু সব ধরনের কুকুরের জন্য প্রতি বছর কর প্রদানের ব্যবস্থা থাকলে সেটি অনেকের জন্যই সমস্যা হবে।
'ইউরোপের দেশগুলোসহ অনেক দেশেই পোষা জন্তু পালনের ক্ষেত্রে ডাটাবেইজ ও করের পদ্ধতি আছে। তবে সেই অনুরূপে আমাদের শহরে করলে সেটি অবশ্যই সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাথে সাথে এসব পোষা প্রাণীকে সিটি কর্পোরেশন কী ধরনের সেবা দেবে তারও নীতিমালা থাকা আবশ্যক,' বলেন তিনি।
কোনো সেচ্ছাসেবী সংগঠন কিংবা ব্যক্তি যারাই কুকুর, হরিণ কিংবা ঘোড়া পুষবে তাদের সবাইকেই কর দিতে হবে উল্লেখ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ডেপুটি ভিফ রেভেনিউ অফিসার শাহজাহান আলী বলেন, তাই অনেকেই কর নেওয়ার বিষয়টি জানে না। কর আহরণ নিশ্চিত করতে তারা নিয়মিত তালিকা হালনাগাদ করবেন।
বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে খামার আকারে হরিণ পালনের সুযোগ রয়েছে। ১০টি হরিণ থাকলেই তাকে খামার হিসাবে গণ্য করা হবে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এ ধরনের খামারের জন্য লাইসেন্স ফি ২০ হাজার টাকা, সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ১০ হাজার টাকা।
প্রতিটি হরিণের জন্য পজেশন ফি ১ হাজার টাকা দিতে হয়।
ভারতের কলকাতা, গুরুগ্রাম, লক্ষ্ণৌ, পুনে, ইন্দোর, বেঙ্গালুরু, গাজিয়াবাদসহ বেশ কয়েকটি শহরে কুকুরের নিবন্ধনের ব্যবস্থা রয়েছে। নিবন্ধনের পরে একটি ধাতব টোকেন নম্বর জারি করা হয়, যা সর্বদা কুকুরের গলার কলারে থাকতে হবে। প্রাথমিক নিবন্ধন ফি ৫০০ রুপি, আর বার্ষিক পুনঃনবায়নকরণ ফি ২৫০ রুপি।
ভারত সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জরুরি প্রাণী উদ্ধার, প্রাণী জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রভৃতি কাজের জন্য এই নিবন্ধন ফি ব্যবহার করে।
চীনে কুকুরের মালিকদেরও একটি কুকুরের জন্য ৬০ ডলার করে ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। নিবন্ধন শেষে কুকুরসহ মালিকদের সব তথ্য দিয়ে একটি ইলেকট্রনিক আইডি দেওয়া হয়।