রংপুর সিটি নির্বাচন: যে কারণে জামানত বাজেয়াপ্ত হলো আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর
২০১২ সালে নির্দলীয় নির্বাচনে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ১ লাখের বেশি ভোট পেয়ে প্রায় ২৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে নিকতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোস্তাফিজার রহমানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।
দশ বছর পর এবার রংপুর সিটির তৃতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান (হাতি প্রতীক) দুজনেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া পেয়েছে মাত্র ২২ হাজার ৩০৬ ভোট আর লতিফুর রহমান পেয়েছে ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙল প্রতীকের মোস্তাফিজার রহমান ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী, 'কোনো প্রার্থী নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের এক-অষ্টমাংশ (আট ভাগের এক ভাগ ভোটের কম) অপেক্ষা কম ভোট পেলে তার জামানতের টাকা সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।'
নির্বাচন কমিশন সুত্রে জানা যায়, এই সিটির ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৭০ ভোটারের মধ্যে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩৬ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ভোট প্রদানের হার ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সে হিসাবে জমানত রক্ষার জন্য প্রয়োজন ৩৫ হাজার ১২২ ভোট। যেখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা অনুসারে, রংপুর সিটির নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে ২০ হাজার টাকা করে জামানতের বিধান রয়েছে। আইন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়ার জমা রাখা জামানতের ২০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
১৯১৮ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের জন্য জামানাতের টাকা জমার বিধান ও বাজেয়াপ্তের বিধান চালু কর হয়। রাষ্ট্রের অনুকূলে এই জামানত বাজেয়াপ্তের অর্থ হলো, নির্বাচনের ওই প্রার্থীকে স্থানীয় জনগণ প্রত্যখান করল। এই বিধানের উদ্দেশ্য হলো, কোনো নির্বাচনে কোনো ব্যক্তি যাতে নিজেকে বুঝে-পড়ে প্রার্র্থী হিসেবে নিজের অবস্থান বিবেচনা করতে পারে এবং যেন-তেন ব্যক্তি যাতে প্রার্থী হতে না পারে।
কেন জামানত বাজেয়াপ্ত হলো আওয়ামী লীগের প্রার্থীর
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্থানীয় রাজনীতির অন্তর্কোন্দল ও তুলনামূলক 'দুর্বল' প্রার্থী মনোনয়নের কারণে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া কম ভোট পেয়ে জামানত হারিয়ে রয়েছেন চতুর্থ অবস্থানে।
এছাড়াও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার না করাকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকে।
তাই টানা দ্বিতীয়বারের মতো রংপুর সিটির নগরপিতা হিসেবে নির্বাচিত হতে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন জাতীয় পার্টির মনোনীত দলটির মহানগর সভাপতি লাঙল প্রতীকের মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
অন্তর্কোন্দল ও দুর্বল প্রার্থী
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর জামানত হারানোর পেছনে মূল কারণ হলো নিজেদের দলীয় বিরোধ। বিশেষ করে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিউর রহমান সফি ও সাধারণ সম্পাদক কুষার কান্তি মণ্ডলের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে নৌকার ভোটবাক্সে।
নৌকার একটি বড় অংশের ভোট পড়েছে রংপুর কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সহসভাপতি ও বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলনের (হাতি মার্কা) বাক্সে।
অন্যদিকে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করেছেন লাঙলের প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। দলীয় ফ্যাক্টরের সঙ্গে ব্যক্তি ইমেজকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশ জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন করেছে।
তাদের ভাষ্য, মোস্তফা জাতীয় পার্টির এরশাদের এলাকা রংপুরে 'হেভিওয়েট' প্রার্থী। দলীয় ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে ব্যক্তি ইমেজও তার শক্তি।
মেয়র পদে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন অন্তত ছয়জন। মনোনয়নবঞ্চিত এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভালো ভাবমূর্তির নতুন কোনো প্রার্থী দিলে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতো না। আলোচনায় নেই—হঠাৎ করে এমন প্রার্থী দেওয়ায় সমর্থকরাও মুখ ফিরিয়েছেন।
সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) রংপুর বিভাগের সম্পাদক আফতাব হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের রংপুর লাঙলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এই দুর্গে আওয়ামী লীগের তেমন একটা শক্তিশালী অবস্থান নেই। সেখানে আবার আওয়ামী লীগ মনোয়ন দিয়েছে দিয়েছে তুলনামূলক দুর্বল প্রার্থী।
তিনি বলেন, হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া আওয়ামী লীগের রংপুর জেলার সদস্য। তিনি একবার সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি ছিলেন। এছাড়া তার আর কোনো দলীয় পরিচয় নেই্ এবং নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের সময় তার তেমন কোনো উল্লেখ করার মতো কার্যক্রম নেই।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে স্বচ্ছ নির্বাচন
সুজন কেন্দ্রীয কমিটির সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সহজীকরণে আওয়ামী লীগ রংপুর সিটি নির্বাচনে বেশ কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। তিনি বলেন, এর কারণ হলো আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত করতে চাচ্ছে, সেটির ওপর যেন সারাদেশের মানুষের একটা আস্থা তৈরি হয়। সে হিসেবে প্রার্থীও মনোয়ন দিয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আগের সিটি বা স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দলীয়ভাবে যেভাবে প্রভাব বিস্তার, কেন্দ্র দখল এবং ভোট কারচুপির সাথে জড়িত ছিল, রংপুরে সেটি করেনি। এই মর্বাচনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে এটি স্পষ্ট হয়েছে, "আওয়ামী লীগ জনগণকে দেখাতে চায়, আগামী নির্বাচন এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হবে।"'
যা বললেন স্থানীয় নেতারা
রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিয়ার রহমান সফি বলেন, 'আমরা এই নির্বাচনে হেরেছি। কেন হেরেছি, এটির কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছি। তবে দলের মধ্যেও কিছু সমস্যা ছিল, এটা অস্বীকার করছি না।'
কেন তুলনামূলক দুর্বল প্রার্থীকে মনোনয়ন দিল আওয়ামী লীগ—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটি কেন্দ্রের বিষয়, আমি কিছু বলতে পারব না।'
জাতীয় পার্টি রংপুর মহানগর সম্পাদক এসএম ইয়াসীর বলেন, 'মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি। এছাড়াও গতবার তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ৫ বছর সিটির অনেক উন্নয়ন করেছেন। একইসাথে রংপুরের মাটি ও মানুষের নেতা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ভালোবাসার জাতীয় পার্টিকে রংপুরের মানুষ অসীমভাবে ভালোবাসে। ফলে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীর ভূমিধস বিজয় হয়েছে।'
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করলেও ২০১২ সালে দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে দলীয় প্রতীকহীন ওই নির্বাচনে তিনি জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। ভোটের ব্যবধান ছিল প্রায় ২৮ হাজার। এরশাদের নির্দেশ না মেনে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মোস্তফা ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন।
২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সব নেতার আশীর্বাদ ও লাঙল প্রতীক নিয়ে মেয়র হন মোস্তফা। প্রায় ৯৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ঝন্টুকে। এবারের নির্বাচনেও সেই মোস্তফাই জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করলেন। আর জামানত হারালেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রেহী প্রার্থী দুজনেই।