এনআইডি সংশোধন প্রক্রিয়া কেন এত দীর্ঘ? চট্টগ্রামেই আটকে আছে ১০ হাজারের বেশি আবেদন!
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা হাসনা বানুর (৭০) পিতার নাম শাহ আলম হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম উঠেছে শামছুল আলম। পিতার সম্পত্তি অন্য তিন ভাই-বোন পেলেও নামের ভুলে পাচ্ছেন না তিনি, দিতে পারছেন না সন্তানদেরকেও। ভুল ধরা পড়ার পরপরই তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে আবেদন করেন সংশোধনের জন্য।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে এনআইডিতে নিজের বাবার নাম ঠিক করে দেওয়ার জন্য আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে যাওয়া-আসা করছেন হাসনা বানু। কিন্তু এখনো কোন সমাধান পাননি তিনি।
'আইডি কার্ড করার সময় তারা আমাদের জন্মদাতা পিতার নামই পাল্টে দিলো। মৃত্যুর আগে সহায় সম্পদগুলো সন্তানদের দিয়ে যেতে চাই। এই বুড়ো বয়সে দুই বছর ধরে নির্বাচন কমিশনে ঘুরছি, কোনো সমাধান মিলছে না,' গত ৬ ডিসেম্বর আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন হাসনা বানু। বর্তমানে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন তিনি।
তার মতো আরেক ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সঞ্জয় মল্লিক। তিনি বলেন, '১৯৭০ সালে আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, সেই সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে। কিন্তু আঞ্চলিক নির্বাচনী কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলছেন, সার্টিফিকেট ছাড়া নাম সংশোধন হবে না। কিন্তু শিক্ষাবোর্ড ১৯৯০ সালের আগের কোনো সার্টিফিকেট নেই।'
শুধু হাসনা বানু বা সঞ্জয় মল্লিক নয়, প্রায় এক যুগ আগে দেশের নাগরিকদের জন্য তৈরি ছবিসহ ভোটার তালিকার নানা অসঙ্গতি সংশোধন করতে প্রতিমাসে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আবেদন করেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে। নির্বাচন অফিসের তথ্যমতে, প্রতি মাসে ২৫ হাজার সমস্যার সমাধান হলেও সমাধান পান না বাকিরা।
এ আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে সেবা চাইতে আসা লোকজনেরা জানান, ভুল সংশোধনের জন্য অফিসের কর্মকর্তারা প্রতিবার নতুন নতুন শর্ত দিয়ে ফিরিয়ে দেন তাদেরকে। আঞ্চলিক এ নির্বাচন অফিসটিতে এভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন হাজারো মানুষ।
প্রকাশ্যেই চলে ঘুষ লেনদেন
দ্বারে-দ্বারে ঘুরে হাসনা বানু বা সঞ্জয় মল্লিকরা সমাধান না পেলেও কিছু মানুষকে টাকার বিনিময় নিজেদের কাজ করিয়ে নিতে দেখা যায়। আর এই ঘুষ লেনদেন হয় প্রকাশ্যেই।
গত ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক মানুষ এনআইডি সংশোধনের জন্য অপেক্ষা করছেন। ফাইল হাতে ঘুরছেন নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দ্বারে-দ্বারে। এসব সেবাপ্রার্থীদের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। নির্বাচন অফিসের কিছু কর্মচারী ও দালালকে ভূক্তভোগীদের প্রকাশ্যেই ঘুষের প্রস্তাব দিতে ও ঘুষ নিতে দেখা যায়।
মো. দিদার নামক এক দালালের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, 'আপনার যেই সমস্যাই হোক সমাধান করা যাবে, শুধু টাকার প্রয়োজন।'
টাকা কারা নেবেন জানতে চাইলে দিদার বলেন, 'কর্মকর্তারা নেবেন, আপনি কাজ করাবেন টাকা দেবেন না? টাকা দিলে সব হয়।'
চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার রিকশা চালক নুর মিয়া। ২০০৭ সালে ভোটার হওয়া নুর তার এনআইডি কার্ডটি হারিয়ে ফেলেছেন। এক দালালের হাত ধরে নির্বাচন অফিসে এসেছিলেন নতুন এনআইডি সংগ্রহের জন্য।
নুর মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '৩,০০০ টাকার চুক্তি, ২,০০০ টাকা দিয়েছি। আজ ফিঙ্গার নিলে আরও বাকি ১,০০০ টাকা দিতে হবে।'
দালাল ও নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের এভাবে ঘুষ লেনদেনের কাজ চলতে থাকলেও কর্মকর্তারা তাদের কাজ ঠিকমতো করেন না বলেই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর তিন সপ্তাহের তদন্তে দেখা গেছে। ভুক্তভোগীদের কেউ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তারা দেখা করেন না। এমনকি ফোন করা হলেও তারা ফোন ধরেন না।
টাকা পৌঁছে যায় যথাস্থানে
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে জাতীয় পরিচয়পত্রের মৌলিক তথ্য যেমন নাম-বয়স ও ঠিকানা পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন সেবা নিতে আসা ব্যক্তিরা।
আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান টিবিএসকে জানান, তার দপ্তরে এ বিষয়ক ১০ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে আছে, যার কোনো কোনোগুলো দুই বছরের অধিক পুরোনো।
চলতি মাসে অন্তত তিন দিন সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের অফিসকক্ষের বাইরে ভিড় করেছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু সারাদিন অপেক্ষা করেও নির্বাচন কর্মকর্তার দেখা না পেয়ে ভুক্তভোগীরা কর্মচারীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান।
মো. আরিফ নামক এক ভূক্তভোগী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, নাম সংশোধনের জন্য তিনি আড়াই বছর ধরে নির্বাচন কমিশন অফিসে আসছেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি নির্বাচনী কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
'তিনি নিয়মিত অফিসে আসেন না, কখনো দুপুরের পরে আসেন। ফোন ধরেন না,' অভিযোগ করেন এ ভুক্তভোগী।
হাসানুজ্জামানের অফিসের লোকজনকে দেখা গেছে সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে। এছাড়া ঘুষের বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার আশ্বাস দিতেও দেখা যায় তাদেরকে।
১৫ ডিসেম্বর কাজ করে দেওয়ার আশ্বাসে মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের কার্যালয়ের পিয়ন রুপক বড়ুয়াকে এক সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিতে দেখা যায়।
কিছুক্ষণ পরে নির্বাচন কার্যালয়ের নিচে সোলায়মান ও শহিদুল নামক দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের; যারা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী না হয়েও নিজেদের হাসানুজ্জামানের লোক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন।
'এখানে (হাসানুজ্জামানের কার্যালয়ে) সরাসরি কাজ সম্ভব নয়, বছর ঘুরলেও এখানে কাজ হবে না। বরং কাজ আমাদের মাধ্যমেই করতে হবে,' সোলায়মান বলেন।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কথা ইঙ্গিত করে শহিদুল বলেন, 'তারা সরাসরি ঘুষ নেবেন না, কিন্তু টাকা ঠিকই তাদের কাছে পৌঁছে যাবে।'
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমি এখানে সম্পুর্ণ বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছি। যাদের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
'আমি সরকারি ফোন নাম্বার ব্যবহার করি না, তাই ব্যক্তিগত ফোনে কোনো অপরিচিত কল আসলে ধরি না,' বলেন তিনি।
হাসানুজ্জামান দাবি করেন, ১০,০০০ ফাইল আটকে থাকা তার ভুল নয়। 'যারা ভুল তথ্য দিয়েছে এটা তাদের ভুল। তারা বারবার আমার কাছে এসে আমাকে হয়রানি করছেন,' বলেন এ কর্মকর্তা।
সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কেন দেখা করেন না জানতে চাইলে মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'আমি মানুষের সঙ্গে দেখা করার মানুষ না, কাজের মানুষ। মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তথ্যকেন্দ্র রয়েছে।'
তবে সরেজমিনে দেখা যায়, নির্বাচনী কার্যালয়ে একটি তথ্যকেন্দ্র থাকলেও সেখানে কোনো কর্মকর্তা থাকেন না।