চা শিল্পে আবারও অসন্তোষ, আন্দোলনে শ্রমিকরা
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত আগস্টে আন্দোলনে নেমেছিলেন চা-শ্রমিকরা। এতে স্থবির হয়ে পড়ে চা শিল্প। টানা ১১ দিন কর্মবিরতির পর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ৫০ টাকা মজুরি বাড়ে শ্রমিকদের। এরপর কাজে ফেরেন তারা।
এ ঘটনার চার মাস না পেরোতেই চা-শ্রমকিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ফের অসন্তোষ। বর্ধিত মজুরির বকেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন তারা। এই দাবিতে ডিসেম্বর থেকে সিলেটের বিভিন্ন বাগানে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। ৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেও বিক্ষোভ করেছেন চা-শ্রমিকরা।
একাধিক চা শ্রমিক সংগঠনও এসব বিক্ষোভ কর্মসূচীতে অংশ নিচ্ছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের ২০ মাসের বকেয়া মালিকপক্ষ পরিশোধ করছে না।
দেশের ১৬৬ চা-বাগানে ১ লাখ ৩ হাজার স্থায়ী ও ৩৫ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক আছেন।
শ্রমিক সংগঠনগুলো সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের দাবিতে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন চা-বাগান মালিকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবু বকেয়া আদায় হয়নি। ফলে দাবি আদায়ে আন্দোলনে নেমেছে তারা।
৩ জানুয়ারি নবীগঞ্জে সড়ক অবরোধ করে ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের শ্রমিকরা। ইমাম বাগানের শ্রমিক নিরলা ঝড়া বলেন, "বাগান কর্তৃপক্ষ যদি দ্রুত আমাদের বকেয়া না দেয় তাহলে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যাব।"
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর পরপর চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা-সংসদের সাথে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। আলোচনার মাধ্যমে চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
কোনো কারণে এই চুক্তি নির্ধারিত সময়ের পরে হলে প্রথা অনুযায়ী আগের চুক্তি শেষ হওয়ার পর থেকেই বর্ধিত মজুরি কার্যকর হয়। এক্ষেত্রে বকেয়া বর্ধিত মজুরি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরিশোধ করে মালিকপক্ষ।
চা শ্রমিকদের সাথে মালিক পক্ষের সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। সে হিসেবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে নতুন করে চুক্তি করে সে অনুযায়ী মজুরি কার্যকর হওয়ার কথা। তবে সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মালিক-শ্রমিক নেতাদের একাধিক বৈঠক হলেও মজুরির বৃদ্ধির ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দুপক্ষ।
এ অবস্থায় মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত আগস্টে দেশের সবগুলো চা-বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। ১৯ দিন লাগাতার তাদের কর্মবিরতির পর ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চা-বাগান মালিকদের বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে চা-শ্রমিকদের মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণার পর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন চা-শ্রমিকরা।
এই ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত ১৭০ টাকা করে মজুরি প্রদান করা হচ্ছে। তবে প্রথা অনুসরণ করে আগের চুক্তি শেষ হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সময়ের বর্ধিত মজুরি প্রদান করা হয়নি। ফলে প্রায় ১৯ মাসের বর্ধিত মজুরির বকেয়া পরে আছে শ্রমিকদের।
এ ব্যাপারে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, "বকেয়া আদায়ের জন্য আমরা মালিকদের কাছে একাধিকার ধর্ণা দিয়েছি। শ্রম অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় এমনকি ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি।"
তিনি বলেন, চা শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। এখন বকেয়া না পেয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এদিকে, বকেয়া পরিশোধের দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর সিলেট সদর উপজেলা চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে চা-শ্রমিকের ১০ দফা বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি। একইদিনে একই দাবিতে লাক্কাতুরায় বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন। এরপর জেলা পশাসক বরাবরে স্মাকলিপি প্রদান করের তারা।
চা-শ্রমিকের ১০ দফা বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ও খাদিম চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সবুজ তাঁতি বলেন, অনেক শ্রমিকের ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বকেয়া পড়ে আছে।
আগের প্রত্যেকটি চুক্তির বর্ধিত বকেয়া অংশ পূর্ববর্তী চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরদিন থেকে কার্যকর হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, "এবারই কেবল মালিকরা টালবাহানা করছেন। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মজুরি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বকেয়া মজুরির বিষয়ে কিছু বলেননি।"
তিনি বলেন, বকেয়া পরিশোধ করা না হলে আবার তারা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবো।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা-সংসদ সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জি এম শিবলী বলেন, "আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মজুরি প্রদান করছি। বকেয়া প্রদানের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।"