মেট্রো, মহাসড়কের জন্য আরও ৭ বিলিয়ন ডলারের সহজ শর্তে কোরিয়ান ঋণ পাওয়ার আশা
কোরিয়ার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল (ইডিসিএফ) থেকে পাঁচ বছরে (২০২২–২০২৬) ৩ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন ঋণের আশ্বাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ এখন একই উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার নতুন উইন্ডো ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ) থেকে ২০২৩ হতে ২০২৭ সালের মধ্যে আরও ৭ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা করছে।
ইডিপিএফ গঠন করা হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে সহায়তা দেওয়ার জন্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা বলেছেন, এই ঋণ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থার ঋণের তুলনায় সস্তা হওয়ায় সরকার এ তহবিল থেকে প্রতি বছর ১ থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার পেতে চায়।
কোরিয়ান ইডিপিএফের আওতায় এগারো প্রকল্প
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা শেষে ইডিপিএফ তহবিল অর্থায়ন বাস্তবায়নের জন্য মোট ১১টি প্রকল্প বাছাই করা হয়েছে বলে তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান। প্রকল্পগুলোর মধ্যে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকায় এমআরটি লাইন-৫-এর দক্ষিণ রুট ও এমআরটি লাইন-৪ এবং ঢাকা রিং রোড।
অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেড ইউনিট-২, ওয়ার্কশপ নির্মাণ, জ্বালানি স্থাপনা ও দাড়িপাড়ায় ব্রডগেজ রোলিং স্টকের জন্য একটি ডিপো, কর্ণফুলী নদীর উপর রেল-কাম-সড়ক সেতু নির্মাণ, উত্তরার স্যানিটেশনের উন্নয়ন, উভয় পাশে সার্ভিস লেনসহ বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা সড়ককে চার লেনের মহাসড়কে উন্নীতকরণ এবং ৫ম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রাম।
ইডিপিএফ ঋণ ইডিসিএফ ঋণের তুলনায় ব্যয়বহুল, কিন্তু জাপান ব্যতীত অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের তুলনায় সস্তা। তবে জাপান তার নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ দেয়, আর কোরিয়ান ঋণ দেওয়া হয় মার্কিন ডলারে।
ইডিপিএফ ঋণের সুদের হার ১ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সময় পাওয়া যাবে ৩০ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড থাকবে ৭ বছর।
অন্যদিকে ইডিসিএফ ঋণের সুদের হার ০.০১ শতাংশ থেকে ০.০৫ শতাংশ। এই ঋণ পরিশোধের সময় পাওয়া যায় ৪০ বছর এবং গ্রেড পিরিয়ড থাকে ১৫ বছর।
ইডিসিএফ ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের শুধু কোরিয়ান ঠিকাদাররা অংশ নিতে পারে। তবে ইডিপিএফ ঋণের আওতায় বাস্তবায়িত প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত থাকবে।
এডিবি ও কোরিয়ার যৌথ অর্থায়নে হবে এমআরটি-৫
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, কোরিয়ার সঙ্গে এমআরটি-৫ প্রকল্পে যৌথভাবে অর্থায়ন করবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এর বাইরে আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পের জন্য যৌথ অর্থায়ন নিয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
কর্ণফুলী রেল-কাম-সড়ক সেতু নির্মাণ এবং উত্তরা স্যানিটেশন উন্নয়ন প্রকল্প ইডিসিএফ ও ইডিপিএ উভয় ঋণই ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে সূত্র।
সূত্র আরও জানিয়েছে, ইআরডি চলতি বছরের মধ্যে কোরিয়ার ইডিপিএফ ঋণের কাঠামো চুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে।
ইআরডির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, ইপিডিএফ ঋণ দিয়ে বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত ১১টি প্রকল্পের মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) প্রণয়নের কাজ এখনও শেষ হয়নি। তবে কোরিয়ান সরকার প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, কোরিয়া ইতিমধ্যে এডিবির সঙ্গে এমআরটি লাইন-৫ প্রকল্পে যৌথ অর্থায়নে সম্মত হয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় গাবতলী থেকে আফতাবনগর পশ্চিম পর্যন্ত ১২.৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সাবওয়ে এবং আফতাবনগর সেন্টার থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা গত নভেম্বরে শেষ হয়েছে। এখন নানা ধরনের জরিপ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনের কাজ চলছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এর ভিত্তিত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে।
কোরিয়ান এক্সিমব্যাংক ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল রুট নির্মাণে ঋণ দিতে আগ্রহী। ইআরডি এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের তথ্যানুসারে, ঋণ প্রস্তাবটির জন্য এখন দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের অনুমোদন লাগবে।
এমআরটি লাইন-৪-এর ঋণ চূড়ান্ত করতে কোরিয়ান সরকারকে প্রস্তাব দেওয়া হবে
এমআরটি লাইন-৪ নামে পরিচিত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রুটটির জন্য ঋণ চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশ শীঘ্রই কোরিয়ান সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠাবে বলেও জানান তারা।
মেট্রোরেল প্রকল্পের রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাস্তবায়নকারী এবং ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, এমআরটি লাইন-৪ কাঁচপুর হয়ে যাবে এবং এর কমলাপুর-যাত্রাবাড়ী অংশ ভূগর্ভস্থ হতে পারে। এছাড়া কাঁচপুরে মেঘনা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করতে হবে এবং এ রুটের কাঁচপুর-মদনপুর অংশটি উড়ালপথে করা হবে।
প্রায় ১২ বছর আগে উদ্যোগ নেওয়া হলেও ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেডের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের কাজ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার আশা করছে, প্রকল্প ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ—আনুমানিক ১৯ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা—বহন করবে কোরিয়া।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্যান্য প্রকল্প এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
চলতি মাসেই স্বাক্ষর হতে পারে ৩ বিলিয়ন ডলারের ইডিসিএফ ঋণ চুক্তি
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, কোরিয়ার সঙ্গে ৩ বিলিয়ন ডলারের ইডিসিএফ ঋণের কাঠামো চুক্তি এ বছরের জানুয়ারিতেই স্বাক্ষর হতে পারে। তবে প্রকল্পভিত্তিক আলাদা আলাদা ঋণ চুক্তি হওয়ার পর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
ইডিসিএফ তহবিলের অর্থায়নে যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিআরটিসির জন্য সিএনজি সিঙ্গেল ডেকার এসি বাস ক্রয়, ঢাকা ওয়াসার জন্য একটি আধুনিক আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেলওয়ে-কাম-সড়ক সেতু নির্মাণ এবং বিএসএমএমইউতে একটি মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি ও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল (২য় পর্যায়) প্রতিষ্ঠা।
বিএসএমএমইউতে ২য় ধাপে ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৭৫০ শয্যার সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রথম সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে বলে জানিয়েছেন ইআরডি কর্মকর্তারা। বিএসএমএমইউ ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সাথে প্রস্তাবিত ৭৫০ শয্যার দ্বিতীয় চিকিৎসা স্থাপনাটি শাহবাগকে আগামী পাঁচ বছরে 'হাসপাতাল হাব'-এ পরিণত করবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে ২০০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটিতে সাধারণ অস্ত্রোপচার, গাইনোকোলজি, সার্জিক্যাল অনকোলজি এবং ইএনটি ও চোখের চিকিৎসা করানোর সুবিধা থাকবে। হাসপাতালটিতে একটি ৫০-৬০ শয্যার ডায়ালাইসিস কেন্দ্রও থাকবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। সেখানে শিশুদের জন্য ১০টি শয্যা থাকবে।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক জুলফিকুর রহমান খান আশা প্রকাশ করেন, এই হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা দেশের দুই ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতাল স্কয়ার হাসপাতাল ও এভারকেয়ার হাসপাতাল ঢাকার [পূর্ববর্তী অ্যাপোলো হসপিটালস] সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
তিন টিবিএসকে বলেন, 'রোগীরা মূলত বিদেশে যায় সেখানকার হাসপাতালের পরিবেশ ও মেডিকেল সার্ভিসের জন্য। কিন্তু আমাদেরও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, আমরাও রোগীদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পারি। যদি চিকিৎসা দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনাকে দেশে একই হাসপাতালের মধ্যে আনা যায়, তাহলে চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অবশ্যই কমে যাবে।'