সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল: ডাক্তাররা বেশি সময় দেওয়ায় সন্তুষ্ট রোগীরা
''আমি ভেবেছিলাম এই বুঝি ডাক্তার বলবেন আপনি এখন চলে যান। কিন্তু তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করেছেন। ডাক্তার এতো সময় নিয়ে কথা শুনবেন চিন্তার বাইরে ছিল," বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথাগুলো বলেন নারায়নগঞ্জের বাসিন্দা সানোয়ারা বেগম।
দশ মাস আগে ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন ৬০ বছর বয়সী সানোয়ারা। নারায়নগঞ্জের স্থাানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে তাকে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তার ছেলেমেয়েরা। নিজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে সানোয়ারা বেগম জানান, "আমার সঙ্গে কথা বলার পর ডাক্তার আমার ছেলের কাছ থেকে সমস্যার কথাগুলো শুনলেন। তারপর টেস্ট আর ওষুধ লিখে দিলেন। এক সপ্তাহ পর আবারও রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বলেছেন।"
৩০০ টাকা ভিজিট দিয়ে নিউরো ডিপার্টমেন্টের একজন অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসরকে দেখিয়েছেন সানোয়ারা বেগম।
ডাক্তার দেখিয়ে সানোয়ারা বেগমের মতো খুশি গাজীপুরের তাসলিমা আক্তারও। সন্তান জন্মের ৪৫ দিন পরও হেমোরেজ হচ্ছে, তাই গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখাতে এসেছেন তসলিমা। ৬০০ টাকার টিকিট কেটে প্রফেসর দেখিয়েছেন তিনি।
তাসলিমা আক্তারের বোন নাসিমা সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "৬০০ টাকা হিসেবে প্রাইভেট হাসপাতালের মত সার্ভিস পেয়েছি। ডাক্তাররা অনেক সময় নিয়ে রোগী দেখেছেন। অত্যাধুনিক হাসপাতাল, পেশেন্ট কেয়ার ম্যানেজমেন্ট অফিসাররা অনেক সহায়তা করছে।"
''তবে একটি সমস্যা হলো, এক জায়গায় টিকিট কেটে ব্যাংকে যেতে হচ্ছে, টাকা জমা দিয়ে তারপর আবার রিসিট জমা দিতে যেতে হচ্ছে, হিস্ট্রি বলতে হচ্ছে। ডাক্তার দেখোনোর আগে তিন থেকে চার জায়গায় যেতে হবে। এটি একটি সমস্যা। প্রক্রিয়াটা আরেকটু সহজ হলে ভালো হতো'' যোগ করেন মাহফুজা সুলতানা।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে উদ্বোধনের প্রায় সাড়ে তিন মাস পর গত ২৭ ডিসেম্বর এর কার্যক্রম শুরু হয়। এখন শুধু আউটডোর সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। ১৪টি ডিপার্টমেন্টে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১টা ও বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত রোগী দেখছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।
হাসপাতালের ৫টি সেন্টারসহ ইনডোর সার্ভিস পুরোদমে চালু হতে আরো তিনমাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ আল হারুন টিবিএসকে বলেন, "সব সময় রোগীদের অভিযোগ থাকে ডাক্তাররা তাদের সময় দেননা, কথা শুনতে চাননা। আমরা সেটিই নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। প্রতি ঘণ্টায় ৬ জনের বেশি রোগী আমাদের ডাক্তারেরা দেখেবেনা।"
"একজন ডাক্তার ১০ থেকে ১২ মিনিট সময় দিয়ে রোগী দেখবেন। এখনো আমাদের প্রচার প্রচারণা তেমন নেই, তাই মানুষজন তেমন জানেনা। আগামীতে রোগীর চাপ আরো বাড়বে বলে আশা করছি," যোগ করেন তিনি।
যে ১৪টি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরামর্শ ও সেবা দেওয়া শুরু করেছেন সেগুলো হলো- সাধারণ শিশুরোগ, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ, চক্ষু বিভাগ, বক্ষব্যাধি, নিউরোলজি, নেফ্রোলজি (কিডনি), ইউরোলজি, কার্ডিওলজি, কার্ডিয়াক সার্জারি (থোরাসিক সার্জারি সহ), সার্জিকাল অনকোলজি, অর্থোপেডিকস, হেপাটোলজি (লিভার), গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোবিলিয়ারি এবং প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি বিভাগ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২৭ ডিসেম্বর আউটডোর চালুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ১০৫ জন রোগী হাসপাতাল থেকে সেবা নিয়েছেন। এছাড়া, প্রতিদিন গড়ে ৮৫ জন করে রোগী আসছেন। সকালের শিফটে রোগীর চাপ বেশি থাকে। অর্থোপেডিক ও গাইনি ডিপার্টমেন্টে আসে সবচেয়ে বেশি রোগী। অন্যদিকে, হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারি, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ও রেসপেরেটারি মেডিসিন বিভাগে রোগীর চাপ তুলনামূলক কম।
হাসপাতাল চালুর পর চিকিৎসকেরা সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালে রোগী দেখতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না বলে শোনা যাচ্ছিলো। তবে সে সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ আল হারুন বলেন, "নতুন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ক্ষেত্রে অনেকেরই শুরুতে দ্বিধা থাকে। প্রথম দিকে যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন, তাদের অনেকেই এখন এখানে বসতে রাজি হয়েছেন। এখন বিএসএমএমএমইউ এর সিনিয়র চিকিৎসকেরাও বসছেন এখানে।"
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বিশাল এলাকাজুড়ে অত্যাধুনিক হাসপাতালটির ভবনের নিচতলায় ওয়েলকাম ডেস্ক। সেখানে তিনজন বসে আছেন। তারা রোগীকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিয়ে সাহায্য করছেন। এক্সেলেটরের পাশেই টিকিট নেওয়ার ডেস্ক, নিচতলায় ব্যাংক। নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত এখন আউটডোর সেবা দেওয়া হচ্ছে।
প্রতি ফ্লোরের এস্কেলেটরের সামনে দাঁড়ানো দুজন পেশেন্ট কেয়ার ম্যানেজার রোগী ওপরে উঠলেই সামনে এসে জানতে চান কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন, কোথায় যাবেন। তারপর তারা রোগী ও তাদের স্বজনদের ডাক্তারের রুমে যেতে সহায়তা করেন।
হাসপাতালের ভেতরে ফার্মেসি ছাড়াও তিনটি ক্যাফেটেরিয়া আছে, যা রোগী এবং তার স্বজনেরা ব্যবহার করছেন।
ব্যবস্থাপনা ভালো রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে
হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে পুরো কাযর্যক্রম সুন্দর করে পরিচালনার জন্য ট্রেনিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক।
তিনি বলেন, "ডাক্তার, নার্স, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ, অ্যাকাউন্টস স্টাফ এমনকি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীসহ ১৫০ এর বেশি স্টাফ কোরিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। আমরা ট্রেইন্ড (প্রশিক্ষিত) কর্মী নেওয়ার চেষ্টা করছি। তারপরও প্রতিটি স্তরের কর্মীদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি। রোগী যা চায় আমাদের কাছে, তা যেনো ভালোভাবে দিতে পারি, সে চেষ্টা আমাদের থাকবে।"
বিএসএমএমইউ'র ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতাল এখন যেভাবে চলছে পুরোদমে চালু হলে এর ব্যবস্থাপনা এমনই রাখার চেষ্টা করবো আমরা। আমাদের সঙ্গে কোরিয়ার ৫৬ জন বিশেষজ্ঞ থাকবেন। বাইরের ডাক্তাররা চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি এখানকার ডাক্তারদের ট্রেনিংও দেবে। এছাড়া, আমাদের ডাক্তারদেরও দেশের বাইরে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হবে।"
অধ্যাপক ডা. শরফুদিন আরও বলেন, "কিছু যন্ত্রপাতি এখনো এসে পৌঁছায়নি বলে পুরোদমে হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছেনা। আমরা আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে পুরোদমে চালু করতে পারবো।"
"এই হাসপাতাল চালুর মাধ্যমে আমরা দেশের সব রোগীর দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে চাই, যাতে রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না হয়। ভবিষ্যতে এখানে রোবটিক সার্জারি, বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, স্টেম সেল থেরাপি দেওয়া হবে," যোগ করেন তিনি।
বিএসএমএমইউর উত্তর দিকে ৩.৪ একর জমিতে ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক বিশেষায়িত এই হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। নির্মাণ ব্যয়ের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ঋণ হিসেবে দিয়েছে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।
হাসপাতালে রয়েছে ৭৫০টি বেড। এছাড়া থাকবে ১৪টি অতি-আধুনিক অপারেশন থিয়েটার, একটি ১০০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ), ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিট, ছয়টি ভিভিআইপি ও ২২টি ভিআইপি কেবিন এবং ২৫টি ডিলাক্স কেবিন।
এর আগে, ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।