পাহাড়ে সৌর বিদ্যুতের সেচ প্রকল্পে উপকৃত বান্দরবানের কৃষকেরা
পাহাড়ের পাদদেশে যারা ফলদ বাগান করে তাদের অনেক খরচ করে তেলচালিত মোটরের মাধ্যমে সেচ দিতে হয়। এতে তেলের খরচ পড়ে অনেক বেশি। কৃষকের লাভ হয় কম। তেলচালিত মোটর ব্যবহার করে বাগানে সেচের ব্যবস্থা করতে অনেক কৃষকের সামর্থ্যও থাকে না।
তাছাড়া শুধুমাত্র পানির অভাবে অনাবাদী হয়ে পড়ে থাকত অনেক সমতল ধানি জমিও। পানির সেই সংকট ঘুচিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) পাহাড়ি এলাকায় সৌর বিদ্যুতের সেচ প্রকল্প।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) সেচ প্রকল্পের প্রকৌশলী আবু নাঈম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সৌরশক্তির মাধ্যমে বিএডিসির দুই ধরণের সেচ প্রকল্প রয়েছে। একটি হলো সমতলের ধানি জমিতে এলএলপি (লো লিস পাম্প)। যেটি একটি খাল থেকে খাঁড়া উচ্চতায় সর্বোচ্চ ৩০ ফুটের উপরে ০.২৫ কিউসেক পানি তুলতে পারে। অপরটি হলো ফলদ বাগান বা গাছে দেওয়ার জন্য ড্রিপ ইরিগেশন। ড্রিপ ইরিগেশনের মাধ্যমে ঘণ্টায় উঁচু পাহাড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার লিটার পানি তোলা সম্ভব।
উপকারভোগী কৃষকরা বলছেন, পাহাড়ে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ঠিকমত সেচ দেওয়ার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। বিদ্যুৎ কিংবা তেলচালিত মোটরের প্রয়োজন পড়ে না। পুকুর, খাল কিংবা কোথাও পানির উৎস পেলে সেখানে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে একটি মোটর বসিয়ে কৃষি কাজে সেচ ব্যবহার করতে পারছেন তারা। যার কারণে একদিকে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে খরচ না থাকায় লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
সম্প্রতি বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়নের উদালবনিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটর লাগিয়ে খাল থেকে পানি তুলে বোরো মৌসুমের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন কৃষকরা। কোথাও তৈরি করা হচ্ছে বীজতলা। কোথাও শীতকালীন বিভিন্ন শাকসবজি ক্ষেতে সেচ দেওয়া হচ্ছে।
রাজবিলা ইউনিয়ন ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষক লুলামং মারমা বলেন, রাজবিলা এলাকায় রবি মৌসুমে পানি সংকট চলে। চাষযোগ্য জমি থাকা সত্ত্বেও কেউ চাষ করতে পারছিল না। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটর লাগিয়ে ভাল করে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। পানি পেয়ে তার ২ একর জমিতে রবিশস্যের মধ্যে সরিষা, সূর্যমুখী ফুল, বাদাম, টমেটো, মাল্টা, কলা ও বোরো ধান লাগানো হয়েছে।
হেডম্যানপাড়ার মংশৈথুই মারমা নামে এক কৃষক বলেন, তারও ২ একর জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন সবজি, আলু ও সূর্যমুখী ফুল চাষ করা হয়েছে। আগে তেলের মাধ্যমে মোটর চালাতেন। লাভের একটা অংশ তেলের জন্য খরচ হত। এখন কোন খরচই নেই। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটর চালিয়ে অনায়াসে পানি পাওয়া যাচ্ছে। পানি নিয়ে আর চিন্তা করতে হয় না।
একই এলাকার সাচিং মারমা ও ক্যচিংপ্রু মারমা নামে দুই কৃষক জানান, তাদেরও ২ একর করে জমি রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন শীতকালীন সবজি ক্ষেতের পাশাপাশি ফলদ বাগান করা হয়েছে। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে তাদের কয়েকটি পুকুরে পানি শুকিয়ে যায়। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেখানে এখন অনায়াসে পানি রাখা যায়।
এই এলাকার কৃষকদের মতে, একসময় ৪০ শতক জমির চাষাবাদে সেচের জন্য তেল খরচ লাগত তিন হাজারের বেশি টাকা। লাভ থাকত কম। এখন কোন খরচই লাগে না। এছাড়া এই এলাকা মাটির বৈশিষ্ট্য হল ভূ-গর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচের পানি দিলে উৎপাদন কম হত। এখন সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানির কারণে কৃষিতে উৎপাদনও বাড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তৈরি করা রাজবিলা ইউনিয়নে মোট পাঁচটি সৌর বিদ্যুৎ চালু রয়েছে। বজ্রপাতের কারণে গত বছর একটি সোলার নষ্ট হয়েছে। সেটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। একটি সৌর বিদ্যুতের অধীনে ১০ থেকে ২০ জন কৃষক চাষ করতে পারে বলে জানিয়েছেন রাজবিলা ইউনিয়নের উদালবনিয়া এলাকার কৃষকরা।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা লুলামং মারমা আরও বলেন, তাদের ২৩৮৫ ওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুতে মোট ৯টা সোলার প্যানেল রয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে তিনটার মধ্যে সূর্যের তাপ প্রখর থাকে। এসময় পানির প্রবাহও বেশি থাকে। তাদের এই সৌর বিদ্যুতে ১৫ থেকে ২০ জন কৃষকের মোট ১০ একর জমি আবাদ হয়ে থাকে।
তিনি জানান, রক্ষণাবেক্ষণ বলতে সৌর বিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। মোটর সেকশন পাইপে বালু, বিভিন্ন পাতা পরিষ্কার করে রাখতে হয়। পাইপে ময়লা অথবা কোন কিছু পড়ে আটকে গেলে ওয়াশ করে রাখতে হয়। এগুলো দেখভাল করার জন্য 'হেডম্যান পাড়া সোলার সেচ প্রকল্প' নামে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।''
এদিকে রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন কৃষি উদ্যোক্তা পাহাড়ে্র পাদদেশ ১৫ একরজুড়ে ফলদ বাগান গড়ে তুলেছেন। তার বাগানে রয়েছে ১১০০টি বল সুন্দরী কুল, ৫০০টি ড্রাগন ফলের চারা, ৩০০টি মাল্টা গাছ ও ২০০টি আলুবোখারার গাছ।
সেচ দেওয়ার জন্য তার বাগানেও বসানো হয়েছে ২০০০ ওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুৎ। ২৫০ ওয়াট করে মোট ৮টা সোলার প্যানেল রয়েছে। পাহাড়ের উপরে বসানো হয়েছে ২০০০ লিটার ধারণক্ষমতার একটি বড় ড্রাম।
সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটর চালিয়ে পাশে একটি পুকুর থেকে ৩০০ ফুটের উপরে পানি তোলা হয়। প্রথমে পানি জমা করা হয় এই বড় ড্রামে। তারপর বিভিন্ন ফলদ গাছের গোড়ায় ছোট পাইপের মাধ্যমে স্প্রে করে সেচ দেওয়া হয়।
আনন্দসেন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, সেচ সবসময় দিতে হয় না। বরই গাছের ফুল ও ফল আসার সময় নিয়ম করে সেচ দেওয়া লাগে। সৌর বিদ্যুৎ না হলে তার এ বাগান গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। তেলচালিত মোটর দিয়ে হলে অনেক খরচ হত। তবে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হলে আশেপাশে পানির উৎস থাকতে হবে বলে জানান তিনি।
বিএডিসির সেচ প্রকল্পের প্রকৌশলী আবু নাঈম জানান, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এ সেচ প্রকল্পের আওতায় বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় মোট ২৬টি এলএলপি সোলার এবং ১৫টি ড্রিপ ইরিগেশন সোলার দেওয়া হয়েছে। মোট ৪১টি স্কিম ম্যানেজারের অধীনে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। এলএলপি সোলারে ১৪ লাখ টাকা এবং ড্রিপ ইরিগেশনে ৬ লাখের কাছাকাছি খরচ হয় বলে জানান এই প্রকৌশলী।
তবে বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় পানির মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকল্প বাড়ানোর জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।