ঋণপত্র সমস্যায় তীব্র হচ্ছে অস্ত্রোপচার সরঞ্জাম সংকট
গত বছরের জুনে জন্মগত হৃদরোগ (হার্টে ছিদ্র) ধরা পড়ে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বালুয়া গ্রামের ১২ বছরের শিশু নজরুল ইসলাম পলাশের। ২৩ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে বিভিন্ন মেডিকেল টেস্টের পর চিকিৎসকরা জানান, পলাশের সার্জারি করতে হবে। চিকিৎসকেরা তার বাবা-মাকে এজন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। একটি অক্সিজেনেটরসহ বেশ কিছু সার্জিকেল ডিভাইস কিনতে বলা হয় তাদের।
কিন্তু পলাশের বাবা মোখলেসুর রহমান অক্সিজেনেটরের ব্যবস্থা করতে না পারায় এখনও তার সার্জারি করা যায়নি। বাইপাস সার্জারির সময় অক্সিজেনেটের হার্টের কাজ করে। এর মূল কাজ কার্বন-ডাই-অক্সাইড সরিয়ে রক্তে অক্সিজেন দেওয়া।
ডিডব্লিউবি নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি আব্দুস সালাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মোখলেসুর ৫ জুলাই অক্সিজেনেটর প্রি-অর্ডার করার পর থেকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায় অক্সিজেনেটর আমদানি সম্ভব হয়নি।
সালাম জানান, এরকম প্রায় ৩৫৪টি অক্সিজেনেটরের প্রি-অর্ডার রয়েছে তাদের কোম্পানির কাছে। গত সাত মাসে একটি এলসিও খুলতে না পারায় সেগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব অক্সিজেনেটর সাধারনত চীন, তাইওয়ান, ও জাপান থেকে আমদানি করা হয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট-সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে সেখানে প্রায় ৩০০ জন রোগীর হার্টের বাইপাস সার্জারি, ওপেন হার্ট সার্জারি, ভালভ রিপ্লেসমেন্টসহ বিভিন্ন অপারেশন হয়। কিন্তু অক্সিজেনেটরের অভাবে গত জুলাই মাস থেকে সেখানে প্রতি মাসে মাত্র ২০-৩০ জন রোগীর অপারেশন হচ্ছে।
হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, 'সরবরাহকারীরা আমাদের লিখিত দিয়েছে, আপাতত অক্সিজেনেটর দিতে পারছে না। কবে নাগাদ দিতে পারবে, তা-ও নিশ্চিত করেনি।'
হার্টের বাইপাস সার্জারিসহ যেকোনো অপারেশনের জন্য সব রোগীরই অক্সিজেনেটর লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, "তবে শুধু বয়ষ্ক কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সার্জনরা 'বিটিং হার্ট' পদ্ধতির মাধ্যমে কিছু জরুরি সার্জারি করছেন। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সার্জারি পুরোই বন্ধ।"
শিল্পসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, শুধু অক্সিজেনেটর নয়, ডলার সংকটের কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলতে না পারায় গত বছরের নভেম্বর থেকে হার্টের ভালভ, পেসমেকার, রিং, হার্টের স্টেন্ট ও অক্সিজেনেটরসহ বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে পারছে না। এতে হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, নিউরোসার্জারি, কিডনি সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্জারিগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
চিকিৎসকেরা বলেন, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের প্রায় ১৫টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের জন্য অপারেশনের কার্যক্রম ব্যাহত গত সাত মাস ধরেই।
দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ থেকে ১২০টি ভালভের প্রয়োজন হয়। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া বেশিরভাগ হাসপাতালে ভালভ রিপ্লেসমেন্টের কাজ বন্ধ রয়েছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের একজন চিকিৎসক নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, সব হাসপাতালেই প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টের ঘাটতি রয়েছে, তাই তারা রোগীদের বাড়িতে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিনি বলেন, অনেক রোগী আছে যাদের অবিলম্বে ভালভ রিপ্লেসমেন্ট প্রয়োজন হয় এবং তাদের অনেকের ভালভ দ্রুত প্রতিস্থাপন করা না হলে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু ভালভ সংকটের কারণে অনেক রোগীর চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে।
ভালভ, পেসমেকার, রিং, ও অক্সিজেনেটরসহ বিভিন্ন ধরনের ইকুইপমেন্ট আমদানি ও সরবরাহ করে লিডিং ইলেক্ট্রো মেডিকেল।
কোম্পানিটির একজন পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'এখন দুই দিক থেকে সমস্যা হচ্ছে। বাংলাদেশে এলসি খোলাটা কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়া প্রিন্সিপাল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর মাসে আমরা যে এলসি খুলেছিলাম, সে মালামাল চলে এসেছে। প্রিন্সিপাল কোম্পানি কাগজপত্র জমা দিয়েছে, কিন্তু ব্যাংকের কাছে ডলার না থাকার কারণে পেমেন্ট দিতে পারছে না।'
তিনি আরও বলেন, ডিসেম্বরের শুরুতে তাদের কিছু পণ্যের একটি চালান এসেছিল। আগে প্রতি মাসে কয়েকটা করে এলসি খোলা হতো। প্রতি বছরে প্রায় ২০ লাখ ডলারের ইকুইপমেন্ট আমদানি করা হতো। কিন্তু গত ৪-৫ মাস ধরে এলসি খোলা পুরোপুরি বন্ধ আছে। ফলে এখন তারা পুরো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
'ভেবেছিলাম জানুয়ারি থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না। প্রতিদিন ব্যাংকের সাথে কথা বলি, কিন্তু ব্যাংক জানায় ডলার নেই। আগে হাসপাতালগুলোকে আমাদের পণ্য নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতাম। এখন হাসপাতালগুলো রোগীদের আমাদের নাম্বার দিয়ে দিয়েছে ভালভ, পেসমেকার আসছে কি না খোঁজ নিতে। রোগীর আত্মীয় স্বজনেরা প্রতিদিন আমাদের ফোন দিচ্ছেন, আমরা তাদের কোনো আশার কথা বলতে পারছি না। হাসপাতালে চাহিদা আছে কিন্তু আমরা সরবরাহ দিতে পারছি না।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেও কাজ হচ্ছে না
এ বছরের ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ঔষধ প্রশাসন মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমতি প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়। ওই চিঠির একটি অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকেও পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ডিসেম্বর মাসে আবেদনে জানিয়েছে যে আমদানিকারকগণ গত নভেম্বর থেকে জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ব্যাংক হতে এলসি খুলতে পারছেন না।
কিন্তু নিত্যপণ্য আমদানি করার জন্য এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত মেডিকেল ডিভাইস নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এলসি সমস্যার কারণে সব ধরনের আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য এলসি খোলার সুযোগ করে দিতে। তাদের সাথে দ্রুত বসে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
সাবেক স্বস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, এসব মেডিকেল ডিভাইস, ইকুইপমেন্টকে নিত্যপণ্য বিবেচনা করে সরকারের উচিত যেসব প্রতিষ্ঠান এসব ডিভাইস ও ইকুইপমেন্ট আমদানি করে, তাদেরকে বিশেষভাবে এলসি খোলার সুযোগ করে দেওয়া।
তিনি বলেন, এসব ডিভাইস আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বিভিন্ন রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিনিময়ে এসব ডিভাইস আনার জন্য উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।
আমদানির ওপর ব্যাপক নির্ভরতা
বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মেডিকেল ডিভাইসের চাহিদা রয়েছে। শতকরা ৭০ ভাগ চাহিদা মেটানো হয় আমদানি করে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আইটেমগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই নিষ্পত্তিযোগ্য। কিছু অর্থোপেডিক পণ্য, অস্ত্রোপচারের জীবাণুনাশক, হাসপাতালের আসবাবপত্র, হোম কেয়ার ডিভাইস, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম এবং অন্য ছোট যন্ত্র উৎপাদন করা হয় দেশে, যদিও তা স্বল্প পরিসরে।
বাংলাদেশ ইনডেন্টিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাসুম বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার, যেমন হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, নিউরোসার্জারি, কিডনি অপারেশন, অর্থপেডিক সার্জারিসহ প্রায় সব ধরনের সার্জারির জন্য বিদেশ থেকে প্রায় ১০০ ধরনের ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে হয়।
দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত আমদানি করা উচ্চ প্রযুক্তির ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে কার্ডিয়াক স্টেন্ট, কার্ডিয়াক পেসমেকার, কৃত্রিম হার্ট ভালভ, ডিজিটাল রক্তচাপ মনিটর ও ডিভাইস, শ্রবণ সহায়ক ডিভাইস, রক্তের ব্যাগ, প্রস্রাবের ব্যাগ, ডায়ালাইজার টিউব, মেডিকেল ভেন্টিলেটর ও ডিজিটাল থার্মোমিটার। নিউরো সার্জারির জন্য ক্ল্যাম্প, কিউরেটস, ড্রিল বিট ও ইমপ্যাক্টর, এলিভেটর ও স্প্রেডার, হুক ও প্রোব, রিট্র্যাক্টর, কাঁচি, স্প্যাচুলা ও সাকশন টিউব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এসব ইকুইপমেন্ট সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর।
রফিকুল বলেন, এমনকি এক্স-রে ও আল্ট্রাসাউন্ডের জন্য যে পেপারশিট ব্যবহার করা হয়, সেগুলোও শতভাগ আমদানিনির্ভর।
কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না হাসপাতাল
দেড় বছর আগে বরগুনা জেলা-সদর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ও মেশিনারিজের অভাবে হাসপাতালটি এখনও চালু করা যাচ্ছে না।
এই হাসপাতালের জন্য প্রায় ১১৯ ধরনের মেশনারিজ ও যন্ত্র কিনতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের মে মাসে দরপত্র আহ্বান করে।
টেন্ডার পাওয়া তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি মেসার্স অভি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, 'এই যন্ত্রগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ রকম যন্ত্রই আমদানিনির্ভর। এলসি খুলতে না পারায় এগুলো আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছি।'
ল্যাবএইড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এ. এম. শামীম টিবিএসকে বলেন, এলসি সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি আমদানি করতে না পারায় তাদের নতুন ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হচ্ছে।
ওষুধের কাঁচামালের সংকট দেখা দিতে পারে
বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এলসি সংকটের কারণে নতুন চালান আমদানি করতে না পারায় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো এখন মজুত করা কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু এলসি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চলতি বছরের মে-জুন মাসে ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।