এক বছরে ৬৩ জেলার মানুষকে সেবা দিয়েছে কুমিল্লার যে হাসপাতাল
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার শংকরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথালমোলজি (বিকো) অ্যান্ড আই হসপিটাল। বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি কুমিল্লা পরিচালিত বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর সবচেয়ে বড় এই সেকেন্ডারি চক্ষু হাসপাতালটি গত বছর দেশের ৬৩ জেলার মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছে।
২০২২ সালে এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন এক লাখ ৯২ হাজার ৪৯৫ জন।
চোখের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা, রিফ্রেকশন সার্ভিস, চশমা ও ফার্মেসি সার্ভিস, কাউন্সেলিং, ডা. যোবায়দা হান্নান পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট ও রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ অধিভুক্ত এক বছর মেয়াদী অফথালমিক অ্যাসিস্টেন্ট সার্টিফিকেট কোর্স চালু রয়েছে এই হাসপাতালে। এছাড়া হাসপাতালটির আন্তঃবিভাগে আধুনিক ফ্যাকো মেশিনের মাধ্যমে বয়স্ক ও ছানি রোগীদের অপারেশন, নেত্রনালী অপারেশন, টেরিজিয়াম অপারেশন, স্কুইন্ট এবং টেসিস অপারেশনসহ চোখের অন্যান্য অপারেশন করা হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, এই হাসপাতালে চোখের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সার্জারি স্বল্পমূল্যে করা হয়। যাকাতভোগী, হতদরিদ্র, ভিক্ষুকদের বিনামূল্যে অপারেশন করা হয়। তাছাড়া অন্যান্য চক্ষু হাসপাতাল থেকে এই হাসপাতালের সেবামূল্য ৪০-৫০ শতাংশ কম এবং সেবার মান ভালো হওয়ায় এই হাসপাতালের প্রতি রোগীদের ঝোঁক অনেক বেশি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শুধু হাসপাতাল অঙ্গন নয়, বাইরের সাত জেলায় গিয়ে মেডিকেল ক্যাম্প করে এই হাসপাতাল। বৃহত্তর কুমিল্লার তিন জেলা কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর; বৃহত্তর নোয়াখালীর নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর এবং নারায়ণগঞ্জে এসব ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। যেসব রোগী হাসপাতালে আসতে অক্ষম, তারা নিজ এলাকাতেই সেবা পেয়ে যান। ২০২২ সালে এই হাসপাতালে কুমিল্লা জেলার এক লাখ ২১ হাজার ৯০৩ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১০ হাজার ৩৪৩ জন, চাঁদপুরে আট হাজার ৩৭৬ জন, ফেনীর দুই হাজার ৫৫২ জন, নোয়াখালীর এক হাজার ৯৯২জন, লক্ষ্মীপুরের এক হাজার ৫১৩ জন ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫১৪ জন রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ মোট ১৫ জন চিকিৎসক এবং ২১৩ জন স্টাফ কর্মরত আছেন।
সরেজমিনে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে রোগীর স্রোত। আন্তঃবিভাগে অপারেশনের রোগীদের রাখা হয়েছে। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে রোগীদের অপারেশন করা হচ্ছে। পাঁচ ও চারতলা বিশিষ্ট দুটি ভবনে সেবা নেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা কর্নার ও বিভাগ খোলা হয়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপ তুলনামূলক বেশি। অতিরিক্ত রোগীর কারণে সেবা প্রদানে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তারপরও সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট রোগীরা।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থেকে আসা মো. আবদুল ওহাব বলেন, "আমার চোখে ছানি ছিল। এখানে স্বল্পমূল্য অপারেশন করে লেন্স লাগিয়েছি। গত তিন বছর কারো চেহারা স্পষ্ট দেখিনি। এখন সবকিছু বেশ স্পষ্ট দেখছি। হাসপাতালের সেবার মান ভালো।"
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থেকে আসা আলী আসগর বলেন, "হাসপাতালের নিজস্ব বাসে আমরা এখানে এসেছি। আবার একই বাসে এলাকায় ফেরত যাব। এতে হাসপাতাল খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। নেত্রনালীর অপারেশন করেছি। অন্যান্য হাসপাতালে অনেক বেশি টাকা চেয়েছে। তাই এই হাসপাতালে এসে কম দামে অপারেশন করিয়েছি।"
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থেকে আসা ফাতেমা বেগম জানান, "চোখে ব্যথা ছিল। দুই মাস খুব কষ্ট পেয়েছি। এই হাসপাতালে এসে লেন্স লাগিয়েছি। এখন বেশ ভালো লাগছে।"
হাসপাতালে অফথালমিক অ্যাসিস্টেন্ট সার্টিফিকেট কোর্সে পড়তে আসা প্রদীপ কুমার শীল বলেন, "বাংলাদেশে চোখের ডাক্তার অনেক কম। কিন্তু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা এক বছরের কোর্স করার পর ছয়মাসের একটি কোর্স করব। এই কোর্স করার পর ডাক্তারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাব। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।"
অফথালমিক অ্যাসিস্টেন্ট সার্টিফিকেট কোর্সের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এম কে ঢালী বলেন, "আর্থিক সমস্যা থাকলেও কাউকে এই হাসপাতাল থেকে কাউকে ফিরে যেতে হয় না। এই হাসপাতালটি এ কারণে অন্য হাসপাতাল থেকে ব্যতিক্রম। এটি সেকেন্ডারি লেভেলের হাসপাতাল। আমরা এটিকে টারশিয়ারি হাসপাতালে রূপান্তর করতে চাই।"
টারশিয়ারি হাসপাতালে রূপান্তর হলে এখানে চক্ষু প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে আরো জটিল জটিল অপারেশন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতি কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক ডা. এ কে এম আবদুস সেলিম বলেন, "অনেক রোগী আছে, তারা কোনো টাকাপয়সা দিতে পারছেন না। তাদের একদম গ্রাম থেকে আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে আসা হয়। আমাদের যাকাত ফান্ড ও বিত্তবানদের দানের অর্থে তাদের এই সেবা প্রদান করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া হওয়ার কারণে সব জেলার রোগীরা এখানে সহজে যাতায়াত করতে পারেন। হাসপাতালের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের পুরস্কৃত করেছেন। আমরা এই অঞ্চলে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইনস্টিটিউশন করতে চাই। আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান হলে শিক্ষার্থীরা যেমন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পারবেন, পাশাপাশি জটিল অপারেশন স্বল্পমূল্যে করা সম্ভব হবে। আমি আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই কাজে সহযোগিতা করবেন।"
হাসপাতালটি ১৯৯৩ সালে নিবন্ধনভুক্ত হয়। ১৯৯৪ সালে এখানে অপারেশন শুরু হয়। ওই বছর এক হাজার ৭৭৫ জন রোগীর সার্জারি করা হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪৫ জন রোগী এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা একুশে পদকপ্রাপ্ত ডা. যোবেয়দা হান্নান। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। হাসপাতালটি সমিতির অর্থায়নে পরিচালিত। এর সদস্য সংখ্যা ১১২ জন।