বইয়ের দাম বাড়লেও কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে প্রাণবন্ত বইমেলা
রাজধানীর উত্তরা থেকে ৬ বছরের মেয়ে এবং ৮ বছরের ছেলেকে নিয়ে মঙ্গলবার বিকালে অমর একুশে বইমেলাতে ঘুরে বাচ্চাদের পছন্দের এবং নিজের পছন্দের বেশ কয়েকটি বই কিনেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আহনাফ তালুকদার। যদিও তিনি গত দুই বছর পরিবার নিয়ে বইমেলাতে আসেনি। এবছর করোনা কেটে যাওয়ায় এবং বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি করায় ২১ ফেব্রুয়ারির আমেজ নিতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায় আসেন সপরিবারে।
আহনাফ তালুকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এবছর বইয়ের দাম গত বছরের তুলনায় বেশি। তবে কাগজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় যতোটা বৃদ্ধি করার কথা ছিল ততো বেশি না। দাম একটু বেশি হলেও নিজের সাধ্যের মধ্যে বাচ্চাদের পছন্দের কয়েকটি ছড়া, ভূতের গল্পের বই এবং নিজে তিনটি উপন্যাস ও অনুবাদ গ্রন্থ কিনেছি। এবছর মেলায় এসে সবকিছুই ভালো লেগেছে।'
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক জহিরুল আবেদিন জুয়েল বলেন, 'গত দুই বছরের তুলনায় এবারে বইয়ের বিক্রি অনেক ভালো। আমাদের আশানুরূপ বই বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি করোনার আগের বছরগুলোর মতোই। যদিও এবছর কাগজের দাম বৃদ্ধির কারণে বইয়ের দাম কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। আমরা কোনো বইয়ের দামই ২৫% এর বেশি বৃদ্ধি করিনি। এরপরেও এবছর বইমেলায় ভালো লাভ করতে পারবো বলে আশা করছি।'
করোনা মহামারির কারণে বিগত দুই বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে বইমেলা শুরু হয়নি। তবে এবার পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকেই বইমেলা শুরু হয়েছে। বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের পর থেকে যতোই দিন যাচ্ছে বইমেলা প্রাঙ্গণে ভিড় বেড়েই চলছে। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবারে দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় থাকে।
মঙ্গলবার ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন দুপুরের পর থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থী ও বইপ্রেমীরা আসতে থাকেন। বিগত বছরের চেয়ে এবারের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা প্রাঙ্গণের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় দর্শনার্থী ও ক্রেতারা বেশ খুশি। সাথে প্রকাশকরাও জানিয়েছেন তাদের বইয়ের বিক্রি স্বাভাবিক বছরগুলোর মতো না হলেও এর কাছাকাছি।
অনন্যা প্রকাশনীর প্রকাশক মনিরুল হক টিবিএসকে বলেন, 'বিগত কয়েক বছরের চেয়ে এবছর বইমেলা বেশ ভালো জমেছে। বইয়ের দাম বাড়লেও ক্রেতা কমেনি। কোভিডের পরে বিক্রি ভালো হচ্ছে। এখনও হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের বিক্রি বেশি। এমদাদুল হক মিলনের বইও বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে।'
শব্দশৈলী প্রকাশনীর প্রকাশক ইফতেখার আহমেদ বলেন, 'মেলায় প্রচুর মানুষ আসছে কিন্তু বিক্রি খুব ভালো না। যারা আসছেন তারা যদি একটি করেও বই কিনতেন তাহলে স্টল খালি হয়ে যাওয়ার কথা। গত বছরের চেয়ে ২০-২৫% দাম বেড়েছে। তবে সেটা আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল। আমাদের নন-ফিকশন বই বেশি চলছে।'
বাঁধন পাবলিকেশন্সের প্রকাশক শেখ শাহারুল আলম টিবিএসকে বলেন, 'পরিসর বড় হওয়ায় এবছর সবাই বেশ স্বস্তি পাচ্ছে। মানুষের ঢলও বেড়েছে। আশা করছি বিগত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবো। আমরা বইয়ের দাম বাড়াইনি। আগে ৮০ গ্রাম কাগজে বই ছাপাতাম, এখন ৭০ গ্রাম দিয়ে কিছু কিছু বইয়ে ১৫-২০% দাম বাড়িয়েছি। বিক্রি বেশ ভালো হচ্ছে। উপন্যাসের বিক্রি কম, অনুবাদ গ্রন্থ বেশি চলছে।'
লেখক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, 'একুশের চেতনা নিয়ে বইমেলাটা শুরু হয়েছিল ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। বাংলা ভাষার মতো রক্ত দিয়ে পাওয়ার ভাষা পৃথিবীতে আর নেই। সেই ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বইমেলাটা শুরু হয়েছিল। ১৯৯০ সালে মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির আর আমি তিনজনে উদ্যোগ নিয়েছিলাম বাংলা একাডেমির সাথে যেন সোহরাওয়ার্দীতে যুক্ত করা হয়। আজকে সেই বইমেলাটা বড় হয়ে উঠেছে। এর সাথে ভাষার চেতনা বড় একটা ভূমিকা রেখেছে। ভাষা শহীদরা যে চেতনা সৃষ্টি করে গিয়েছিল সেই চেতনায় মেলাটা আজও চলছে।'
লেখক আনিসুল হক টিবিএসকে বলেন, 'বইমেলা ভাষা আন্দোলনের অনেক পরে শুরু হয়েছে। ভাষা শহীদরা আমাদের শুধু ভাষা আর দেশ দিয়েছেন তা নয়, একটিও বইমেলাও দিয়েছেন। না হলে যে জাতি পড়াশোনার বিষয়ে নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রয়াসী নয়, সে জাতি যে এত বড় বইমেলা করতে পারবে সেটা অসম্ভব ছিল। ভাষা শহীদদের প্রতি আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ।'
বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ২০২২ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কিছুটা দেরি হয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বইমেলা শুরু হয়। গত বছর ৩১ দিন ধরে চলা বইমেলায় প্রায় ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। ২০২১ সালে করোনার মধ্যে অসময়ে চলা ২৬ দিনের বইমেলায় বই বিক্রি হয় মাত্র ৩ কোটি ১১ লাখ টাকার।
তবে এবছর গত বছরের থেকে বেশি বিক্রি হবে বলে প্রত্যাশা করছে প্রকাশকরা।
করোনার আগে ২০২০ সালে বইমেলায় বই বিক্রি হয়েছে ৮২ কোটি টাকার। ২০১৯ সালে ৮০ কোটি টাকার, ২০১৮ সালে ৭০ কোটি টাকার।
এছাড়া ২০১৭ সালে বিক্রি হয়েছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি, ২০১৫ সালে বই বিক্রি হয়েছিল প্রায় ২২ কোটি টাকার। আর ২০১৪ সালে মাস জুড়ে বই বিক্রি হয়েছিল মাত্র সাড়ে ১৬ কোটি টাকার।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেন, 'এবারের মেলায় প্রাণ ফিরেছে। কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দাম একটু বেশি হলেও পাঠকরা বই কিনছেন। গত দুই বছর আমাদের মেলা ছিল নিয়মরক্ষার মেলা। এবারের মেলাতে গত বছরের থেকে বেশি বই বিক্রি হবে। তবে মেলাতে আগে ছাপানো বই আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। যদিও মেলাতে পুরাতন বইগুলোই বেশি চলছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এ মেলা বাঙালি জাতীর একটি ঐতিহ্য। মেলার মধ্য দিয়ে মানুষ উৎসবে সামিল হচ্ছে। একসাথে এতো প্রাণের মিলনমেলা প্রকাশক, লেখকদের উৎসাহিত করে। এ মেলা অন্তত পাঠক এবং দর্শনার্থীদের বইয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে পারছে।'
২১ ফেব্রুয়ারির দিনে (বইমেলার ২১তম দিন) বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৩০৩টি। এরমধ্যে গল্পের বই ৪২টি, উপন্যাস ৩৪, প্রবন্ধ ১৬, কবিতা ৯৬, গবেষণা ১২, ছড়া ১২, শিশুসাহিত্য ৭, মুক্তিযুদ্ধ ৭, ভ্রমণ ৯, জীবনীবিষয়ক ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
গত বছর একুশে বইমেলায় ৩ হাজার ৪১৬টি নতুন বই প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ বই বাংলা একাডেমির 'কোয়ালিটি পাবলিকেশন' হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া ২০২১ সালে ২ হাজার ৬৪০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়।
করোনার আগে ২০২০ সালে নতুন বই প্রকাশিত হয় ৪ হাজার ৯১৯টি, ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৬৮৫টি, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৫৯১টি এবং ২০১৭ সালে নতুন বই প্রকাশ পেয়েছিল ৩ হাজার ৬৬৬টি।