ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে সরকারি প্রণোদনা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা
প্রায় এক মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের আলু রপ্তানি করেছে তিন প্রতিষ্ঠান। রপ্তানির বিপরীতে মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে এক্সপোর্ট প্রসিড। তবে দুর্ভাগ্যবশত তিনটি প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঠিকানায় সরেজমিনে গিয়ে পাওয়া যায়নি কোনো অস্তিত্ব। অথচ মাঝখান দিয়ে তারা অতিরিক্ত ২০% প্রণোদনা লুফে নিচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশেই অবস্থিত রহমান চেম্বার। এই ভবনের ঠিকানায় বিদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এম আর ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির ২০২০-২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আলু রপ্তানি প্রায় ৫০ হাজার ডলারের। তবে গ্রাহকের রপ্তানি আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা নেয়ার আগেই উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। তাদের রপ্তানি আয় বাবদ ডলার দেশে আসলেও আদতে তারা কোন পণ্যই রপ্তানি করেনি।
রহমান চেম্বার ভবনে থাকা নিচের বোর্ডে প্রতিষ্ঠানের তালিকায় মেসার্স এম আর ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল-এর নাম পাওয়া যায়। তবে ঠিকানা অনুযায়ী, ভবনের সাত নম্বর ফ্লোরে গিয়ে মেসার্স এম আর ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের অফিস পাওয়া যায় নি।
একই ফ্লোরে থাকা ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেডের মালিক ডি এন সাহা সহ একাধিক ব্যক্তির কাছে এই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, তারা এ প্রতিষ্ঠান চেনেন না। তবে রহমান চেম্বারের সিকিউরিটি গার্ড শাহাদাত হোসেন বলেন, 'এক ভবনে একই রুমে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে। আমি এ প্রতিষ্ঠানের নামও শুনিনি।'
একই সময়ে মেসার্স তাশা ওয়ার্ল্ড বিডি এক্সপো মালেয়েশিয়ায় আটটি ইএক্সপির মাধ্যমে আলু রপ্তানি করেছে প্রায় ৪ লাখ ডলারের। এছাড়া মেসার্স আহনাফ কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ায় ১১টি ইএক্সপির মাধ্যমে ৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের আলু রপ্তানি দেখিয়েছে।
উপরের দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেয়া রয়েছে ডেমরা, তুষারধারা সাদেক আলমগীর রোডে। তবে প্রতিষ্ঠানটির কোনো ভবনের ঠিকানা উল্লেখ নেই। তবে যে রোডের ঠিকানা দিয়েছে সেখানে বসবাসরত একাধিক লোকের কাছে এমন প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাইলে তারাও 'চেনেন না' বলে জানান।
রপ্তানিকারকরা বলেন, কৃষিপণ্য রপ্তানির আড়ালে অনেক রপ্তানিকারক ভুয়া রপ্তানি দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রণোদনা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর কিছু অংশ ধরা পড়লেও অনেকে কাস্টমস ও অন্যান্য সিএন্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে আঁতাত করে এমন অনিয়ম করছে।
দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও নতুন পণ্য রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন খাতকে সহায়তা দেয় সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে সহায়তা পায় কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য (২০ শতাংশ)। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা রপ্তানি আয় আনতে পারলে সরকার ভর্তুকি দেয় ২০ টাকা।
গত বছরের ১৯ জুন কমিশন অব কাস্টমস, চট্টগ্রাম হাউজ বরাবর আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রেরিত চালানসমূহ যাচাইয়ের জন্য বলে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো। এরই প্রেক্ষিতে এম আর ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, তাশা ওয়ার্ল্ড বিডি এক্সপো ও মেসার্স আহনাফ কর্পোরেশনের রপ্তানি ভুয়া বলে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেখতে পাই আলু রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা সহায়তার ব্যাপক আবেদন আসছে। সেই প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, রপ্তানিগুলো ভুয়া ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমরা জানতে চেয়েছি এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করেছি।'
জানা যায়, গত ডিসেম্বরের ৬ তারিখে এই বিষয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চায়।
চিঠিতে বলা হয়, সাধারণত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রপ্তানিকৃত চালানের বিপরীতে বিল অব এক্সপোর্ট, কমার্শিয়াল ইনভয়েস, ইএক্সপি, বিএল, পিআরসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেম (ওএমইএস) যাচাই করে প্রণোদনার নগদ সহায়তার সুপারিশ করে। তবে শুল্ক কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে রপ্তানি না হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনলাইন ডাটায় এ রপ্তানির তথ্য কিভাবে রয়েছে তা যাচাই করে প্রতিষ্ঠানটিকে জানাতে বলা হয়েছে। এছাড়া রপ্তানি সংক্রান্ত দলিলাদি জাল হওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতনৎকর্মকর্তা বলেন, 'কৃষিখাতে রপ্তানি প্রণোদনা বেশি হওয়ায় কিছু সুযোগসন্ধানী প্রতিষ্ঠান ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে সরকারি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এরকম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি নয়, তবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো এমন করছে তাদের সব সেক্টরে ভালো যোগাযোগ রয়েছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি উত্তরা ব্যাংকের মাধ্যমে ভুয়া রপ্তানির বিপরীতে ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা কেটে রাখা হয়েছে। এছাড়া এর আগে একটি ব্যাংকের মাধ্যমে সুপারি ও মেহগনির বিচি বিদেশে রপ্তানি দেখিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি এমন পরিমাণের রপ্তানি দেখিয়েছে যে পরিমাণ মেহগনির বিচি দেশে বছরে উৎপাদনও হয় না।
আলু রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ড. আব্দুল কাদের টিবিএসকে বলেন, 'এমন ধরণের কাজ কোনভাবেই কাম্য নয়। তাহলে এর দ্বারা আমাদের রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। আপনি যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলেছেন এমন প্রতিষ্ঠানের নাম শুনিনি, আমাদের সংগঠনের মধ্যে থাকলে অবশ্যই আমরা তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করতাম।'
নিয়মানুযায়ী কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ধারিত ডিপোতে শুল্কায়ন করতে হয়। এরপর তা জাহাজে তোলা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের মাধ্যমে যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, তার শুল্কায়নের জন্য ১৯টি বেসরকারি ডিপো রয়েছে। কাস্টমসের তদন্তে এসেছে যে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে জালিয়াতি করা হয় সেই পণ্য ডিপোতেই যায়নি।
ইপিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে কোন ধরণের ট্যাক্স না থাকায় অনেকক্ষেত্রে সরেজমিনে না গিয়েই অনুমোদন দিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া এক কর্মকর্তার বিপরীতে অনেক চালান যাচাইয়ের দায়িত্ব থাকে। ফলে সব সময় সরেজমিনে দেখা সম্ভব হয় না। আবার অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এ সুযোগই নেয় চক্রটি।
জানা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ১০৩ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। এছাড়া কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যে প্রণোদনা দিয়েছে ৬৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল মাত্র আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা।
এদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যে পাওয়া যায়, ঢাকা-ভিত্তিক ডো এম্পেক্স লিমিটেড ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ভুয়া কৃষি-খাদ্য রপ্তানির বিপরীতে ৪.২১ কোটি টাকার প্রণোদনা আত্মসাৎ করেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি প্রণোদনার জন্য প্রতিষ্ঠানটি জাল রপ্তানির ৩০টি বিল লগ করেছে। পাঁচজন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট, তিনটি ডামি শিপিং কোম্পানি এবং কয়েকজন শুল্ক কর্মকর্তাকে এই জালিয়াতিতে জড়িত পাওয়া গেছে।
ডো এম্পেক্সের বিরুদ্ধে তদন্তে ১৮ কোম্পানির ৮৭২টি নকল খাদ্যসামগ্রী রপ্তানির খবর মিলেছে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে পাঁচ বছরে তারা ৩৩ কোটি টাকারও বেশি রপ্তানি প্রণোদনা হাতিয়ে নিয়েছে।
জাল চালানের মধ্যে ১৯১টি আলুর চালান এবং ৬৮১টি খাদ্যপণ্যের চালান রয়েছে।
মুড়ি, মসলা, আলু, তেলবীজসহ কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যেই এই জালিয়াতি হচ্ছে। জালিয়াতি শনাক্ত হওয়া চালানগুলোর বেশিরভাগের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া। শতাধিক চালান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একেকটিতে গড়ে ৫০ হাজার ডলারের পণ্য থাকে (৫৩ লাখ টাকা)। ২০ শতাংশ হারে এর বিপরীতে নগদ সহায়তা দাঁড়ায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা।