একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্ল্যাকআউটে যখন ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষ
দুর্ঘটনার শিকার আত্মীয়কে দেখতে বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান রাজশাহী সদর উপজেলার বাসিন্দা সাদিয়া আক্তার।
কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ওয়ার্ড বা কেবিন নম্বর খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। এমনকি নেটওয়ার্ক না থাকায় মোবাইল ফোনে আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগও করতে পারেননি সাদিয়া।
আত্মীয়র কেবিন খুঁজে পেতে দু ঘণ্টা সময় লাগে তার।
পরে জানতে পারেন, গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক ব্ল্যাকআউটের কারণে সেসময়টায় কাউকে কল দিতে পারছিলেন না তিনি।
সাদিয়ার মতোই গতকাল গ্রামীণফোন ব্যবহারকারী লাখ লাখ গ্রাহক ভোগান্তির শিকার হন।
অনেকেই ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্টের জন্য ফোনে যোগাযোগ করতেপারেন নি।
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কয়েক ঘণ্টা ধরে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হওয়ার কারণে মোবাইল ফাইন্যান্সিং সার্ভিসে লেনদেন, ফুড ডেলিভারি, ব্যাংকিং এবং জরুরি চিকিৎসা পরিষেবাসহ মোবাইল নেটওয়ার্ক-চালিত অনেক ব্যবসা প্রভাবিত হয়।
হঠাৎ করে নেটওয়ার্ক ব্ল্যাকআউটে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে ঘাবড়ে যান অনেকেই।
তবে, অপ্রত্যাশিত ও সাময়িক এ পরিস্থিতির জন্য ক্ষমা চেয়েছে গ্রামীণফোন। ঢাকা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ এবং গাজীপুর এলাকায় সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ কাজের সময় ফাইবার-অপ্টিক ক্যাবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে নেটওয়ার্ক ছিলোনা বলে উল্লেখ করে তারা।
যদিও সারাদেশে গ্রামীণফোনের প্রায় ৭ কোটি ৯০ লাখ গ্রাহক এ সমস্যার সম্মুখীন হয়, মোবাইল অপারেটরটির দাবি, শুধুমাত্র কিছু ব্যবহারকারীই ফোনকল ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সমস্যার মুখে পড়েন।
তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা দাবি করেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ কর্তৃক এলেঙ্গা থেকে গাজীপুর, ঢাকা থেকে গাজীপুর এবং টাঙ্গাইল থেকে সিরাজগঞ্জ রুটে কাজ চলাকালীন সময়ে ফাইবার ক্যাবল কাটা পড়ার কারণে এ সমস্যা হয়েছে।
গ্রামীণফোনের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা সাজ্জাদ হাসিব বলেন, "আমাদের ৫০০জন সদস্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় পর নেটওয়ার্ক পুনরায় সচল করা সম্ভব হয়।"
তাছাড়া, নেটওয়ার্ক ব্যর্থতা এবং তাদের পরিষেবাগুলো পুনরায় চালু করতে কত সময় লাগবে সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা চেয়ে গ্রামীণফোনকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)।
সাধারণত, নেটওয়ার্ক পরিকাঠামোতে এই ধরনের সমস্যা ঠিক করতে প্রায় ১২ থেকে ৭২ ঘন্টা সময় লাগে।
গ্রামীণফোনের হেড অব নেটওয়ার্ক প্ল্যানিং আবুল কাশেম মহিউদ্দিন আল-আমিন বলেন, "নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিয়ে ব্যবহারকারীদের প্রতি আমাদের যে অঙ্গীকার, তার অংশ হিসেবে আমরা মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যে এ সমস্যার সুরাহা করেছি।"
"আজকের ঘটনাটি অবাঞ্ছিত ছিল এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল," যোগ করেন তিনি।
কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিলেন জিপি ব্যবহারকারীরা
জিপির মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায়, কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই অপারেটরের গ্রাহকরা। অনেকেই এ সময়টায় বিকল্প উপায় (অন্য অপারেটর কিংবা ওয়াইফাই) ব্যবহার করে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্যবসায়ী আরাফাত হোসেন বলেন, "হঠাৎ ফোন ও ইন্টারনেট চলে যাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। দেশে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় অনেকের মধ্যে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।"
সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক ছিল না।
রাজশাহীর মানুষও একই সমস্যায় পড়েছেন।
সাতক্ষীরার বাসিন্দা নাসিমা জানান, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিদেশে থাকা স্বামীর সঙ্গে তার জরুরি কথা হচ্ছিলো। কথার মাঝেই হঠাৎ লাইনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি প্রায় ৩০ মিনিট ধরে স্বামীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যান।
এমনকি বাড়ির কাছে একটি টেলিকম দোকানেও ফোনটি নিয়ে যান তিনি। তখনই বুঝতে পারেন যে এ পরিস্থিতির শিকার তিনি একা নন।
এমএফএস-এ কমেছে লেনদেন
গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক ব্ল্যাকআউটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)।
গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বৃহস্পতিবার প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার লেনদেনে সমস্যার মুখে পড়ে এমএফএস।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, সাধারণত একটি কর্মদিবসে এমএফএসে ঘণ্টায় ১৩০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকার গ্রামীণফোনের এজেন্ট সজিব দাস বলেন, সকালে ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশ দুটোই কাজ করা বন্ধ করে দেয়। "প্রথমে সমস্যাটা বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম," বলেন তিনি।
দেশের বৃহত্তম এমএফএস পরিষেবা দানকারি প্রতিষ্ঠান বিকাশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তাদের পরিষেবাটি সম্পূর্ণভাবে নেটওয়ার্ক নির্ভর হওয়ায় বৃহস্পতিবার গ্রামীণফোনের জন্য লেনদেন ব্যাহত হয়।
তবে নেটওয়ার্ক ব্ল্যাকআউটের সময়টায় কী পরিমাণ লেনদেন হয়েছে তা প্রকাশ করেননি তিনি।
কমেছে ফুড ডেলিভারি
যেকোনো সাধারণ কর্মদিবসের তুলনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে গতকাল ফুড ডেলিভারি হয়েছে কম।
সাধারণত, সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফুড ডেলিভারির অর্ডার আসে। এই সময়টায়ই অফিসগামী এবং প্রাইভেট ও কর্পোরেট চাকরীজীবীরা লাঞ্চের অর্ডার দেয়।
কিন্তু বৃহস্পতিবার দুপুরের খাবারের অর্ডার দিতে পারেননি গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহারকারীরা।
তাছাড়া, নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হওয়ার আগে যারা তাদের অর্ডার দিয়েছিল তারাও খাবারের ডেলিভারি পায়নি।
সিলেটের অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের এজেন্ট মারুফ আহমেদ বলেন, সকাল ১১টার পর তিনি তিনটি অর্ডার পান। কিন্তু খাবার পাঠানোর জন্য গ্রাহকদের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি।
ফুডপান্ডা জানায়, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হওয়ার ফলে তাদের ব্যবসায় বেশ প্রভাব পড়েছে, কারণ বেশিরভাগ গ্রাহক অর্ডার দেওয়ার জন্য মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন।
ফুডপান্ডার এক বিবৃতিতে বলা হয়, "ওয়াইফাই এবং অন্যান্য নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে যারা অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার দিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখিনি আমরা।"
প্রবাসীরাও হয়ে পড়েন চিন্তিত
গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।
ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) হলো এমন একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ইনকামিং এবং আউটগোয়িং কলগুলো পরিচালনা করা হয়।
একজন আইজিডব্লিউ অপারেটর টিবিএসকে বলেন, গতকাল গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এবং অভ্যন্তরীণ আন্তঃসংযোগ এক্সচেঞ্জে প্রভাব ফেলে।
"ওই কয়েক ঘণ্টায় কোনো ফোনকল সম্ভব হয়নি," বলেন তিনি।
গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস খায়রুল বাশার বলেন, "অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল হলো টেলিযোগাযোগ এবং জাতীয় অবকাঠামোর মেরুদণ্ড। এই অবকাঠামোর নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের সবাইকে আরও সতর্ক হওয়া উচিত।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, খুলনা ও বগুড়া জেলার প্রতিনিধিরা এই প্রতিবেদন তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন।