যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চাপ ফেলছে ঘোড়াশাল সার কারখানা
নরসিংদীতে ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা বাস্তবায়নের ধীরগতির জন্য সরকারকে এখন তিন দিক থেকে ধাক্কা সামলাতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর।
গত বছরের জুনে উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও এখনও তা পারেনি কারখানাটি। এখন কার্যক্রম শুরু করতে পারার আগেই কারখানাটিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যে সমস্যা সহজ করার কথা ছিল—সার আমদানি—এখন তা করতে পারছে না কারখানাটি। কারণ সরকারকে এখন চাহিদা মেটানোর জন্য এই কৃষিপণ্যটি আমদানি করতে হবেই।
এছাড়া এই বিলম্ব এমন এক সময়ে সরকারের ওপর আর্থিক বোঝা তৈরি করেছে, যখন সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় কঠোরভাবে নানা ধরনের কৃচ্ছ্রসাধন করছে।
২০১৮ সালে অনুমোদন পাওয়া কারখানাটির কার্যক্রম এখন চলতি বছরের নভেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আর ঋণ পরিশোধ শুরু হবে তারও দুই মাস আগে, সেপ্টেম্বর থেকে।
কোনো আয় না থাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ চেয়ে অনুরোধ করেছে।
বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের ধার্যকৃত ২ শতাংশেরও কম সুদহারের ঋণের বদলে ৪.৫ শতাংশের বেশি সুদহারের চড়া ব্যয়ের বিদেশি ঋণ নিয়ে ইউরিয়া সার কারখানাটি স্থাপনের কাজ শুরু হয়।
উচ্চ ব্যয় সত্ত্বেও লক্ষ্য ছিল, বিদ্যমান ঘোড়াশাল ও পলাশ ইউরিয়া কারখানাকে একীভূত করে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি দুটির উৎপাদনক্ষমতা তিনগুণ করা।
এর প্রধান উপকারিতা হতো, ধান উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ব্যয়বহুল সারের ওপর নির্ভর করতে হতো কম।
কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ৯.২৪ লাখ মেট্রিক টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন বিদ্যমান কারখানা দুটি সম্মিলিতভাবে ২.৫ লাখ টন সার উৎপাদন করতে পারে। অর্থাৎ বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনক্ষম হওয়ার কথা নতুন কারখানার।
কিন্তু অন্যান্য আরও অনেক সরকারি প্রকল্পের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও মন্থরগতির কবল থেকে রেহাই পায়নি।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণ চুক্তি ও ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করতে সময় লাগায় এবং কোভিড মহামারির কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে বিলম্ব হচ্ছে।
ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্পের পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঋণচুক্তি কার্যকর হওয়ার পরপরই কোভিড মহামারি শুরু হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি।
আগামী নভেম্বরে কারখানাটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও গত অক্টোবরে প্রকল্পটিতে তিনটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়—গ্যাসের নতুন রেগুলেটিং ও মিটারিং স্টেশন (আরএমএস) স্থাপন, ঘোড়াশাল স্টেশন পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ এবং অফিস ও কর্মীদের আবাসিক ভবন তৈরি।
এসব কাজের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও বেশি সময় লাগতে পারে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানার সভাপতিত্বে গত মাসে অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভাতেও গ্যাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে নতুন আরএমএস স্থাপন, রেললাইন নির্মাণ এবং পুরাতন ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়টিকে পুরোদমে কারখানা চালুর পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওই সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির প্রায় ৭৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ঠিকাদারের ৫ হাজারের বেশি কর্মী নিয়োজিত আছেন। এই তিন চ্যালেঞ্জ উতরাতে পারলে নভেম্বরে উদ্বোধনের পর পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাবে।
সংখ্যায় সংখ্যায়
পুরনো দুটি কারখানার জায়গায় বছরে ৯.২৪ লাখ টন সার উৎপাদন করতে নতুন কারখানা স্থাপনে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ১০ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে তুলনামূলক কঠিন শর্তে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট হিসেবে জাপান ও চীনের ঠিকাদারদের যৌথ কনসোর্টিয়াম—ব্যাংক অভ টোকিও-মিতসুবিশি ইউএফজে লিমিটেড (এমইউএফজি) ও দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড (এইচএসবিসি)—৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকার ঋণ সংগ্রহ করে দেয়।
কমিটমেন্ট ফি, সার্ভিস চার্জ মিলিয়ে এ ঋণের সুদের হার ৪.৫ শতাংশ।
চার বছরের নির্মাণকালসহ মোট ১৫ বছরে কনসোর্টিয়ামকে মোট ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বিসিআইসি সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকার 'নন-কনসেশনাল' ঋণ পরিশোধের জন্য ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা লাগবে।
গত অক্টোবরে বেশ কিছু খাত নতুন যোগ হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় ৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা বেড়ে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণলয় সূত্র জানায়, ১৯৭০ সালে নরসিংদীর ঘোড়াশালে স্থাপন করা বছরে ৫ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদন-সক্ষমতার সার কারখানার উৎপাদন গত বছর অর্ধেকে নেমে আসে।
১৯৮৫ সালে স্থাপিত পলাশ ইউরিয়া কারখানার উৎপাদন সম্প্রতি নেমে আসে ৮০ হাজার টনের নিচে।
যত সংকট
স্টিয়ারিং কমিটির সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী গত অক্টোবরে স্বল্প পরিসরে কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে পারেনি তিতাস।
পুরনো কারখানায় ব্যবহার হওয়া আরএসএম সংস্কার করে গত ডিসেম্বরে সীমিত আকারে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে নতুন আরএমএস স্থাপনে দরপত্র খোলা হয়েছে বলে সভায় জানান প্রকল্প পরিচালক।
দ্রুত আরএমএস স্থাপনের কাজ শেষ করতে সভায় তদারকি বাড়ানোর নির্দেশ দেন শিল্প সচিব। এ লক্ষ্যে শুরু থেকে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের উল্লেখ করে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোরও নির্দেশ দেন তিনি।
রেলপথ নির্মাণের উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদিত সার পরিবহনে কারখানা থেকে ঘোড়াশাল পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ এখনও শুরু হয়নি। বর্ধিত রেট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
এখনও টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় এই কাজ নভেম্বরে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। রেললাইনের কাজ শেষ না হলে প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না-ও হতে পারে।
কারখানার অফিস ও কর্মীদের আবাসনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ৬৬টি ভবন নির্মাণের জায়গা খালি করে দিতে ছয়বার চিঠি দেওয়া হলেও ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটে কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জাানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরুর আগে চলতি অর্থবছরেই সরকারের নিজস্ব তহবিলে চাপ বাড়াচ্ছে প্রকল্পটি। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রকল্পটিতে অতিরিক্ত ৫৫৫ কোটি টাকা চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
চলতি অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এতে বরাদ্দ ছিল ৩০০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বিসিআইসি চেয়েছে ৮৫৫ কোটি টাকা।
'অদক্ষতার বড় উদাহারণ'
পুরো বিষয়টিকে সরকারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার বড় উদাহারণ আখ্যা দিয়েছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-এর (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, সরকারের ব্যয়ের চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে রাজস্ব আয় না বাড়ায় আর্থিক চাপ সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটাই বেড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও নিম্নমুখী চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় বিসিআইসির এই ঋণটি সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাড়াবে বলে মন্তব্য করেন সেলিম রায়হান।
তিনি আরও বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে বিভিন্ন শিল্পের পাশাপাশি এখন অনেক সার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ আছে।
'এ কারণে কারখানাটি উদ্বোধন হলেও সার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ কঠিন হবে।'
এ অবস্থায় ঋণ পরিশোধে কিছুটা বাড়তি সময় চেয়ে আলোচনা জোরদার করার পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান।
প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক বলেন, ২০১৮ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেও বাণিজ্যিক ঋণে বহুপাক্ষিক বিনিয়োগ গ্যারান্টি এজেন্সির (এমআইজিএ) গ্যারান্টি পেতে প্রায় দেড় বছর চলে যায়।
২০২০ সালের মার্চে ঋণচুক্তি কার্যকর হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ায় কাজ শুরু করা যায়নি।
পাঁচ মাস পর সীমিত পরিসরে কাজ শুরু হলেও বিদেশি পরামর্শক ও প্রকৌশলীরা সশরীরে কাজে যোগ দেন আরও আট মাস পর। এসব কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি।
প্রকল্পের মূল কাজ তথা কারখানা স্থাপন সামান্যই পিছিয়েছে জানিয়ে রাজিউর বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মাত্র ছয় মাস বাড়তি সময় চেয়েছে।
ঠিকাদার কাজ পিছিয়ে দেওয়ায় ঋণ পরিশাধে ছয় মাস বাড়তি সময় চেয়ে যোগাযোগ করা হলেও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বাড়তি বরাদ্দের চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্প সংশোধনের কারণে ব্যয় অনেকটা বেড়েছে। বাড়তি ব্যয়ের পুরো অর্থ চলতি ও আগামী অর্থবছরে কাজে লাগাতে হবে। এ কারণে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বাড়তি 555 কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বাড়তি বরাদ্দের চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্প সংশোধনের কারণে ব্যয় অনেকটা বেড়েছে। বাড়তি ব্যয়ের পুরো অর্থ চলতি ও আগামী অর্থবছরে কাজে লাগাতে হবে।
এ কারণে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বাড়তি ৫৫৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নভেম্বরে কারখানাটি উদ্বোধন করবেন বলে জানান তিনি।