রেকর্ড বায়ুদূষণ, শ্বাসকষ্টে ঢাকা
গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা বায়ুদূষণের রেকর্ড গড়ে চলেছে, যে কারণে বেশ কয়েকবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে তালিকার শীর্ষে ছিল দেশের রাজধানী।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮:৫০-এ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী ঢাকার স্কোর ছিল ২৯৭, যেটি পৃথিবীর অন্য যেকোন শহরের তুলনায় সর্বোচ্চ। 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' ক্যাটাগরিতে থাকা এই স্কোর 'বিপজ্জনক' ক্যাটাগরি থেকে সামান্য দূরে রয়েছে।
প্রতিদিনের বাতাসের অবস্থা পরিমাপ করার একটি ইনডেক্স একিউআই, যেটি সাধারণ মানুষকে জানায় তাদের এলাকার বাতাস কতটা পরিষ্কার কিংবা কতটা দূষিত। একইসাথে এই বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলবে সেটিও জানায় তারা।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমোসফিয়ারিক পল্যুশন স্টাডিজ (সিএপিএস) গত সাত বছর ধরে ঢাকার বাতাসের মান নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং একিউআই ইনডেক্সের জন্য প্রয়োজনীয় ডেটা সরবরাহ করছে, যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সির মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
একিউআই স্কোর অনুযায়ী, ০-৫০ স্কোর 'ভালো', ৫১-১০০ স্কোর 'মধ্যম', ১০১-১৫০ 'সংবেদনশীলদের জন্য অস্বাস্থ্যকর', ১৫১-২০০ 'অস্বাস্থ্যকর', ২০১-৩০০ 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' এবং ৩০০-এর ওপরে বিপজ্জনক, যেটি স্থানীয় অধিবাসীদের শরীরের জন্য বেশ বড় হুমকি।
বৃহস্পতিবার দূষিত বাতাসের শহরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা বাগদাদ এবং ইয়াঙ্গুনের স্কোর ছিল যথাক্রমে ২৩৮ এবং ১৯৩।
সিএপিএস-এর ডেটা অনুযায়ী, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বাতাসের অবস্থা ১৩ দিন বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল, যেটি গত সাত বছরে সর্বোচ্চ। এই ১৩ দিনের মধ্যে ১০ দিন ছিল জানুয়ারি মাসে, বাকি ৩ দিন ছিল ফেব্রুয়ারিতে। ১৩ জানুয়ারিতে রেকর্ড ৪০৪ স্কোর করে ঢাকা।
এর বিপরীতে, বিপজ্জনক অবস্থায় বাতাসের মান পৌঁছে গিয়েছিল এমন দিনের সংখ্যা ২০১৭ সালে ৫ দিন, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ৬ দিন, ২০২০ সালে ৭ দিন, ২০২১ সালে ১২ দিন এবং ২০২২ সালে ৫ দিন।
অন্যদিকে, 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' অবস্থায় ছিল ২০১৭ সালে ৬৪ দিন, ২০১৮ সালে ৭৯ দিন, ২০১৯ সালে ৬০ দিন, ২০২০ সালে ৬৯ দিন, ২০২১ সালে ৮৭ দিন এবং ২০২২ সালে ৭৭ দিন।
২০২৩ সালে কেবল জানুয়ারি মাসেই ২০ দিন ছিল 'খুবই অস্বাস্থ্যকর'-এর তালিকায়। সিএপিএস-এর উপাত্ত অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণ বছরের প্রথম মাসেই গত বছরের তুলনায় ২৭% বেড়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার গড় একিউআই ছিল ২২১, যেখানে ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ২৮১-তে এসেছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে গড় একিউআই ছিল ২২৬। যদিও ফেব্রুয়ারি মাসে বায়ুদূষণের পরিমাণ জানুয়ারির তুলনায় কম, তারপরেও গত বছরের তুলনায় এই দূষণ অনেক বেশি।
বাংলাদেশে বাতাসের মান পরীক্ষার জন্য পাঁচটি দূষণকারী পদার্থের পরিমাণ মাপা হয়: পার্টিকুলেট (পিএম১০ এবং পিএম২.৫), নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড এবং ওজোন।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণের সমস্যায় ভুগছে। এর বাতাসের মান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় চলে যায় এবং গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যেতে থাকে, তবে বেশিরভাগ সময়েই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়েই অবস্থান করে।
শীত কমে গেলেও ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর বাতাসের মানের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ দিন 'অস্বাস্থ্যকর' এবং ১৫ দিন 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' অবস্থায় ছিল।
সিএপিএস-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার টিবিএসকে জানান, "বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। ময়লা পোড়ানোও বায়ু দূষণের আরেকটি বড় উৎস, যেটি শহরের বাতাসের অবস্থাকে ক্ষতিকর থেকে খুবই ক্ষতিকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে।"
হৃদযন্ত্রের রোগ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে ইনফেকশন এবং ক্যান্সারসহ বেশ কিছু মারণঘাতী রোগের পেছনের কারণ বায়ুদূষণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, পৃথিবীব্যাপী প্রতিবছর ৭০ লক্ষ মানুষ বায়ুদূষণের ফলে হওয়া স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসে ক্যান্সার, ক্রোনিক পালমোনারি ডিজিজ এবং রেসপিরেটোরি ইনফেকশনে মারা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং পরিবেশবাদী মোহাম্মাদ গোলাম সারওয়ার টিবিএসকে জানান, বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে, তখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে সকল ধরণের দূষণ ঠেকাতে এগিয়ে আসা জরুরি। তিনি জানান, "আমার মনে হয় না পরিবেশ মন্ত্রণালয় দূষণকে বড় কোনো সমস্যা বলে মনে করে। তারা হাই কোর্টের নির্দেশনা মেনে চলতে তেমন আগ্রহী নন। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতাও বাড়ানো উচিৎ।"
গোলাম সারওয়ার যোগ করেন, "বায়ুদূষণের মূল উৎস ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং ইটের ভাটাগুলো। শহরবাসীদেরকে এই বায়ুদূষণ মেরে ফেলছে। গড় আয়ু কমে আসছে, যেটা আমাদের মৌলিক অধিকারকে কেড়ে নিচ্ছে।"
২০২২ সালে করা বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার ৪০% দূষণ হয় শহরের ভেতরে হওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে। বাকি ৬০% দূষণ পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর প্রভাবে হয়।
গবেষণাতে দূষণের উৎসও উল্লেখ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে যানবাহন, কারখানা, ইটের ভাটা, পাওয়ারপ্ল্যান্ট, কাঁচা রাস্তা এবং নির্মাণাধীন এলাকা।