পাথারিয়া সংরক্ষিত বনে আগুনে পুড়ে ছাই ৪০ হেক্টর বন
মৌলভীবাজারের পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের বড়লেখা রেঞ্জের সমনভাগ এলাকায় বনের আয়তন ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর। এই এলাকার ধলছড়ি ও মাকাল জোরায় প্রায় ৪০ হেক্টর জায়গার বন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আট দিন ধরে বনে আগুন জ্বলছে। বিষয়টি জেনেও আগুন নেভানোর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বন বিভাগের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, উল্টো বিভিন্নভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে বন বিভাগ।
বন বিভাগ বলছে, এটি বড় কোনো বিষয় নয়। অন্যদিকে স্থানীয়রা বলছেন, এ ঘটনায় বনবিভাগ নিজেই জড়িত। এই আগুনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কয়েক লাখ উদ্ভিদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরহরিৎ সমনভাগ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের একটি অংশ এবং এটি ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্তব্যাপী ছয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যকার একটি।
সমনভাগ বনাঞ্চলটি বনাঞ্চল এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোর অন্যতম।
শনিবার ১১ মার্চ সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিশ্র চিরহরিৎ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একপাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনে পুড়ে অজগর সাপ, চশমাপরা হনুমান, মায়া হরিণ, কচ্ছপ, বনরুই, সজারুসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির আবাস্থল এবং বিরল কীটপতঙ্গ ও বেশ কিছু প্রজাতির বৃক্ষের ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে বনের একপাশে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তিগুলোকে বিনষ্ট করা হচ্ছে। এসব বাঁশ পরবর্তীতে আগুন দিয়ে পুড়ানো হবে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, স্থানীয় বন বিভাগ বনায়নের নামে অর্থ আত্মসাথের জন্য এই কাজ করছে। গত বছরও তারা একই কাজ করেছে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সেখানে নিয়মিত যাওয়া-আসা করা কামাল আহমদ নামে একজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, 'এক সপ্তাহ আগে বনে আগুন দেখতে পাই। আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় বনের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিষয়টি বন বিভাগকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যার ফলে এখানকার বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণীসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।'
স্থানীয় বাসিন্দা ইদ্রিস আলী বলেন, 'আমি জ্বালানি কাঠ ও নিজের কাজের জন্য বাঁশ নিতে মাঝেমধ্যে বনে আসা-যাওয়া করি। এই বনটি এমন ছিল না। এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো। বনটি পরিপাটি ছিল। তবে এখন আর আগের মতো নেই! সব বনখেকোরা খেয়ে ফেলছে। বনে হাতিও থাকে না। কারণ থাকার কোনো পরিবেশ নেই।'
এ বিষয়ে সমনভাগ বিট কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. নুরুল ইসলাম বলেন, 'উপকারভোগীদের মাধ্যমে ২০ হেক্টর জায়গায় একটি আগর বাগান করা হবে। সেজন্য বন কেটে পরিষ্কার করা হচ্ছে। আগুন লাগার ব্যাপারটি এখানে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হয়তো কেউ বিড়ি খেয়েছে এখানে। আর এটা থেকেই আগুন লেগে বনের চার-পাঁচ হেক্টর ভূমি আগুনে পুড়ে গেছে।'
বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সিলের বন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমি খবর পেয়েছি। যেকোনো অসাবধনতায় হয়তো এই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। ঝোপঝাড়, গাছের ডালপালা কাটা হয়েছে। সেজন্য এখানে আগুন লেগে এই এলাকা পুড়ে গেছে। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছি। আমার স্টাফ আগামীকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।'
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'আমি বনে আগুন লাগার বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু সংরক্ষিত বন এলাকায় আগুন লেগেছে, এতে সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পাখির বাসার ব্যাপক ক্ষতি হবে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম জানান, 'গত বছরও আমরা একই সংবাদ পেয়েছি, কিন্তু তখন যারা দায়িত্বে ছিলেন তারাই এই কাজ করেছিলেন বলে জেনেছিলাম। যেহেতু তারা এখনো বর্তমান আছেন, তাই এই কাজ যে তাদের দ্বারাই হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বনবিভাগ নতুন বনায়ন করে আর্থিক সুবিধা নিতে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করছে, এটা হতাশাজনক।'