ভোলার বেশি দামের গ্যাস কিনতে আগ্রহী নয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো
জ্বালানি চায় গাজীপুর ও ভালুকার শিল্পাঞ্চলগুলো। তাই সরকার প্রস্তাব করেছিল ভোলা থেকে উদ্বৃত্ত গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে। তবে সরকারের এ প্রস্তাবে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না শিল্পগুলো।
পাইপলাইনের মাধ্যমে আনা এ গ্যাস কিছুটা স্বস্তি দেবে মনে করলেও, দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় শঙ্কিত কারখানা মালিকরা।
বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে কম্প্রেসড বা সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম ইউনিটপ্রতি (১ ঘনমিটার) ৪৩ টাকা। এর মধ্যে ফিড গ্যাসের মূল্য ৩৫ টাকা ও অপারেটিং মার্জিন ধরা হয় ৮ টাকা।
কিন্তু কারিগরি কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংকোচন, পরিবহন এবং তারপর ডিপ্রেশারাইজেশনসহ বিভিন্ন চার্জের জন্য প্রতি ঘনমিটার ভোলার গ্যাসের দাম পড়বে প্রায় ৫১.১২ টাকা।
কারখানা মালিকরা দীর্ঘমেয়াদি ফিক্সড চুক্তিতে না গিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দ্বীপটির গ্যাস কিনতে চান। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সরবরাহ করা গ্যাসের চাপ যখন কম অথবা একেবারেই থাকবে না, ওই সময়টুকুর জন্য ভোলার গ্যাস কিনতে চান তারা।
কারখানা মালিকরা ইতিমধ্যে পৃথক আলোচনায় সিএনজিতে রূপান্তর করে ক্যাসকেড সিলিন্ডারের মাধ্যমে তিতাসের বিতরণ এলাকায় শিল্প গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে পেট্রোবাংলার কারিগরি কমিটিকে জানিয়েছেন।
গ্যাসের মূল্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আরএকে সিরামিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের মোম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, দাম যাতে প্রতিযোগিতামূলক রাখা হয়, সেজন্য তারা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন।
'কিন্তু শিল্প গ্যাস এমনকি সিএনজির বর্তমান মূল্যের চেয়েও দাম বেশি রাখলে তা কেনা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো উপায় থাকবে না। কারণ গ্যাস সংকটে কারখানা চালাতে না পারলে পুরোটাই ক্ষতি। বেশি দামের গ্যাস দিয়ে তো অন্তত কারখানা চালু রাখতে পারব,' বলেন তিনি।
এদিকে পেট্রোবাংলার কারিগরি কমিটি ভোলার গ্যাস থেকে আসা সিএনজি রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বদলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে বাজারজাত করার সুপারিশ করেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে আসা একটি নথি অনুসারে, শুধু রূপান্তর এবং বাহকের ভূমিকা ছাড়াও এ প্রকল্পের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইন 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০'-এর আওতায় ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডকে বাছাই করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, আগামী মে মাসের মধ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য সুপারিশসহ একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
ভোলা থেকে গাজীপুর, ভালুকায় নেওয়া হবে ৫ এমএমসিএফ গ্যাস
বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। দৈনিক ৩,৫০০ এমএমসিএফ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ মাত্র ২,৬৮২ এমএমসিএফ।
জ্বালানির অভাবে থাকা বিভিন্ন শিল্পের ক্ষোভের মধ্যে গত বছরের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ভোলার গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সিএনজি আকারে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন।
ভোলা দুটি গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন সক্ষমতা ২০০ এমএমসিএফ হলেও উৎপাদন হয় ৮০ থেকে ৮৫ এমএমসিএফ করে।
এ কারণে শাহবাজপুর ও ভোলা গ্যাসক্ষেত্রের আটটি কূপের প্রায় ১২০ এমএমসিএফ বাড়তি সক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
পাইপলাইন ও সঞ্চালন অবকাঠামোর অভাবে জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন শিল্পাঞ্চলগুলোতে ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস আনতে পারছে না সরকার।
প্রাথমিকভাবে ভোলা থেকে প্রতিদিন ৫ এমএমসিএফ গ্যাস দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। যা জুনের মধ্যে ২৫ এমএমসিএফে উন্নীত হবে বলে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যান্য চার্জ যোগ হয়ে দামি হয়ে উঠছে সস্তা গ্যাস
সংকোচন, পরিবহন এবং তারপর ডিপ্রেশারাইজেশনসহ আরও কিছু চার্জ ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস গ্রাহকদের জন্য অসহ্য রকমের ব্যয়বহুল করে তুলছে।
কারিগরি কমিটির সুপারিশে প্রতি ঘনমিটার ৫১.১২ টাকা দামের মধ্যে ইন্ট্রাকোর ভাগও রয়েছে—প্রথম তিন বছর প্রতি ঘনমিটারে ৩১.২৯ টাকা ও পরের সাত বছর ২৮.১৩ টাকা।
গ্যাস সংকোচন, পরিবহন ও ডিপ্রেশারাইজেশনের জন্য ইন্ট্রাকো প্রথম তিন বছর প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৪৯ টাকা, পাঁচ বছর পর্যন্ত ৪৩ টাকা, সাত বছর পর্যন্ত ৪১ টাকা, পরের তিন বছরের জন্য ৩৯ টাকা নেওয়ার প্রস্তাব করেছে।
কিন্তু কারিগরি কমিটি প্রথম তিন বছরের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৩১.২৯ টাকা এবং ১০ বছরে ২৮.১৩ টাকা প্রস্তাব করেছে।
প্রথম তিন বছর ইন্ট্রাকো সংকোচনের জন্য ঘনমিটারপ্রতি ৮ টাকা, পরিবহনের জন্য ৩৭ টাকা এবং কর ও ভ্যাট ব্যতীত ডিপ্রেশারাইজেশনের জন্য ৪ টাকা প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু উপদেষ্টা কমিটি সমস্ত কর ও ভ্যাটসহ যথাক্রমে ৮ টাকা, ১৮.৫৭ টাকা ও ৪.৬৩ টাকা দেওয়ার কথা ভাবছে।
এই প্রস্তাব তৈরিতে কারিগরি কমিটি ফিড গ্যাসের দাম ও অন্যান্য সরকারি চার্জের পরিমাণ কমিয়েছে।
ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিংয়ের কোম্পানি সেক্রেটারি জিএম সালাহউদ্দিন বলেন, 'বিভিন্ন সময়ের জন্য আমরা ভিন্ন ভিন্ন দর প্রস্তাব করেছি। পেট্রোবাংলার কারগরি কমিটি আমাদের প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দর সুপারিশ করেছে। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না, কারণ প্রস্তাবটি এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিবেচনাধীন। আমরা কারিগরি কমিটির প্রস্তাবিত দরও জানি না।
'কারিগরি কমিটির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অনুমোদন করলে আমরা দরগুলো বিশ্লেষণ করব।'
রাতে গ্যাস সংকটে ভুগছে শিল্প
তিতাস গ্যাসের একটি সূত্র জানায়, গাজীপুর ও ভালুকায় ১৮টি শিল্প গ্রাহক প্রতিদিন ১০ এমএমসিএফ গ্যাসের ঘাটতিতে আছে।
গাজীপুরের মাদার টেক্সটাইলে প্রতিদিন ২.৫ এমএমসিএফ গ্যাস লাগে। কিন্তু তারা গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস পায়, ঘাটতি থেকে যায় ২ এমএমসিএফ।
ইউরো এশিয়া ০.২ এমএমসিএফ গ্যাসের ঘাটতি নিয়ে কারখানা পুরোদমে চালাতে লড়াই করছে। অন্যদিকে প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল ৩০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহের ঘাটতিতে ভুগছে।
চলতি বছরের ৯-১০ জানুয়ারি ভালুকা ও গাজীপুরের আগ্রহী গ্রাহকদের সঙ্গে পেট্রোবাংলা কমিটি পৃথক বৈঠক করে।
কমিটি জানতে পারে, মাত্র আটজন গ্রাহক প্রতিদিন ৫ এমএমসিএফ ভোলা থেকে সিএনজিতে রূপান্তরিত করে আনা গ্যাস নিতে আগ্রহী।
স্পিনিং ও ডায়িং কারখানাগুলোতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ প্রয়োজন।
আগ্রহী গ্রাহকরা এখন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিতাস থেকে প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে।
লোড ব্যবস্থাপনার জন্য তিতাস তাদের জেলা নিয়ন্ত্রক স্টেশন বন্ধ রাখে। তাই ভালুকার কারখানাগুলো রাতে গ্যাস পায় না।
এ কারণে কারখানাগুলো এখন কেবল ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ নিতে আগ্রহী বলে সুপারিশ নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে নারাজ শিল্প
কারিগরি কমিটির সঙ্গে বৈঠকে শিল্প মালিকরা জানান, জ্বালানির দাম উৎপাদন খরচের বড় অংশ হওয়ায় তারা এই উচ্চমূল্যের গ্যাস বেশিদিন ব্যবহার করতে পারবেন না।
তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্যাস ব্যবহার করতে পারবেন। গ্যাস সংকট পরিস্থিতির উন্নতি হলেই তারা তিতাসের বিতরণ ব্যবস্থায় ফিরে যাবেন।
তাই তারা সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে ইচ্ছুক না।
শিল্প মালিকরা বলেন, এই বেশি দামের গ্যাস দিয়ে দীর্ঘদিন কারখানা চালানো একেবারেই অসম্ভব। এতে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকিতে পড়তে পারে।