নির্মাণের পথে আরো দুই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে আরো দুটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এবং দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার বড়পুকুরিয়ায় ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। কেন্দ্র দুটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে (অন গ্রিড) গিয়ে যুক্ত হবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এক বোর্ড সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।
এ লক্ষ্যে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প দুটির জন্য দুটি পৃথক দরপত্র আহ্বান করেছে সংস্থাটি। আগামী ২ এপ্রিল দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। চলতি বছরের জুনে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিপিডিবির নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং গবেষণা ও উন্নয়ন পরিদপ্তরের পরিচালক (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) আহমেদ জহির খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডিটেইলড প্রজেক্ট প্ল্যান (ডিপিপি) প্রণয়নের আগেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যেন দ্রুত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন করা যায়। এখনো প্রকল্প ব্যয় চূড়ান্ত করা হয়নি। এক মাসের মধ্যে ডিপিপি প্রণয়ন করা হবে। এপ্রিলে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আশা করছি, চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে।"
বিপিডিবি নথিপত্রের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ ঘাটচেক এলাকায় বিপিডিবির ১৪৯ দশমিক ২৫৯ একর জমিতে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে এক বছর। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৫৫০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রায় ৯০ হাজার ৯০০টি সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার উপযোগী করতে ১০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৫০০টি ইনভার্টার স্থাপন করা হবে। এখানে প্রতিদিন ২ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।
মূলত ২০২০ সালের মধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় বিপিডিবির জমিতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) হিসেবে ৫৫ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করতে চেয়েছিল দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কনসোর্টিয়াম অব মেটিটো ইউটিলিটিজ লিমিটেড। ৫ দশমিক ৯৮ টাকা প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা দরে এখান থেকে ২০ বছর মেয়াদ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তবে প্রকল্প ব্যয়ের হিসেব করে উদ্যোগটি থেকে পিছু হটে দুবাইভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠানটি। এরপর অনিশ্চয়তায় পড়ে প্রকল্পটি। তবে দেশব্যাপী জ্বালানী ভিত্তিক বিদ্যুৎ সংকটের পর আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে তিন বছর আগের এই উদ্যোগটি।
অন্যদিকে ঢাকা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমের জেলা দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার বড়পুকুরিয়ার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট কমপ্লেক্সে ৬০ একর জমিতে ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ১০ মাস। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৫৫০ ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন প্রায় ৩৬ হাজার ৩৬০টি সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারযোগ্য করতে ১০০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২০০টি ইনভার্টার স্থাপন করা হবে। এখানে প্রতিদিন ৮০ হাজার ইউনিট উৎপাদন হবে।
নতুন দুটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে ২০ বছর মেয়াদী সোলার প্যানেল ও ইনভার্টারগুলো স্থাপন করা হবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটিতে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প দুটির ডিপিপি প্রণয়ন না হওয়ায় ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে বিপিডিবির একজন প্রকৌশলী টিবিএসকে বলেন, "প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনে গড় ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি টাকা। এ হিসেবে রাঙ্গুনিয়ার প্রকল্পে ৪০০ কোটি এবং বড়পুকুরিয়ার প্রকল্পে ১৬০ কোটি টাকার বেশি নিট ব্যয় হতে পারে। এর সঙ্গে ভূমির উন্নয়ন, সড়ক, ভবন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ও যুক্ত হবে।"
১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার পেছনে ছুটছে সরকার
২০২৫ সালের মধ্যে সৌর, জলবিদ্যুৎ এবং বায়ু সহ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ১০% বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার পেছনে ছুটছে সরকার।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মতে, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ২% বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের জন্য এসব উৎস থেকে কমপক্ষে ১২% বিদ্যুতের প্রয়োজন।
এর আগে, সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মোট বিদ্যুতের কমপক্ষে ৫% এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০% উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল; কিন্তু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখনও তার কোনোটিই অর্জন হয়নি।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) প্রস্তুতকৃত 'ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১' অনুসারে, "বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২০ হাজার মেগাওয়াট গ্রিন ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করতে পারে।" এমনকি নদী তীরবর্তী এবং পরিত্যক্ত জমির যথাযথ ব্যবহার করে সৌর বিদ্যুতের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা যেতে পারে বলে সেখানে বলা হয়েছে।
জমির সংকটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পিডিবির অব্যবহৃত জমিগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বরাবর নির্দেশ দিয়ে আসছেন।
রাঙ্গুনিয়া ও বড়পুকুরিয়ায় দুটি প্রকল্পের দরপত্রের সঙ্গে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৭ দশমিক ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্রও আহ্বান করেছে বিপিডিবি। এছাড়া ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যমান ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা আরো এক মেগাওয়াট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (ভৌত অবকাঠামো বিভাগ) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান টিবিএসকে বলেন, "দেশের বিভিন্ন স্থানে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে উপযোগী স্থানের খোঁজে গত বছরের শেষের দিকে বেশকিছু স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে।"
সৌরবিদ্যুতে উৎপাদন ব্যয়ও কম
বিপিডিবির তথ্য বলছে, দেশের ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ২২ টাকা। এলএনজি গ্যাসে ১০ টাকা, বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিদ্যুতে ৪ টাকা, আমদানিতে ৬ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলে ১২ টাকা ব্যয় হয়। তবে এসব বিদ্যুৎ পরিবেশসম্মত নয়। সোলারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৮-১০ টাকা। আর দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় সময়ভেদে ৩০ পয়সা থেকে এক টাকা পর্যন্ত পড়ে।
বিপিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহমেদ জহির খান বলেন, গড়ে সোলারের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ১০ টাকার মতো পড়ে।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একজন সহকারী প্রকৌশলী টিবিএসকে বলেন, "২০১৯ সালে এই কেন্দ্রে নির্মিত ৭ দশমিক ৪ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় ১৪ টাকা। এখন আরো উচ্চতর ক্ষমতা সম্পন্ন প্যানেল ও ইনভার্টার ব্যবহারের ফলে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় কমে ৮ টাকায় নেমে আসবে।"