পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে কোভিড-পরবর্তী জটিলতা প্রায় ৪ গুণ বেশি: গবেষণা
কোভিড–পরবর্তী জটিলতা পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে দেড় থেকে চার গুণ পর্যন্ত বেশি। অন্যদিকে ৪০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী কোভিড থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে হৃদযন্ত্রের জটিলতা ও স্নায়বিক জটিলতার ঝুঁকি দ্বিগুণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য জানা গেছে।
গুরুতর কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা পরবর্তীতে ডায়বেটিস, শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের জটিলতার ঝুঁকিতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত এবং নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হয়েছিল এমন রোগীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সম্ভাবনা হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের তুলনায় দুই থেকে তিন (২-৩) গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া গেছে বলে 'লং টার্ম সিকুয়েল অফ কোভিড-১৯: আ লংগিটুডিনাল ফলোআপ স্টাডি ইন ঢাকা, বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর ডি ব্লকের আইএনএম অডিটোরিয়ামে ইউএসএআইডি এর অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এ অনুষ্ঠানে 'লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন ফর ফিজিশিয়ানস' শীর্ষক একটি নির্দেশিকাও উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার প্রথম পাঁচ মাসের ফলোআপের ফলাফল সম্প্রতি গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়ায় প্রকাশিত হয়। এশিয়ার মধ্যে এটি প্রথম গবেষণা যেখানে দেখা যায়, কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ভোগীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যাকে পোস্ট কোভিড-১৯ সিনড্রোম (পিসিএস) বা লং কোভিড হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত কোভিড-১৯ মনোনীত দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত (আরটি-পিসিআর দ্বারা শনাক্তকৃত) ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৩৬২ জন ব্যক্তিকে এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের কোভিড-পরবর্তী জটিলতা নির্ণয় করার জন্য সেরে ওঠার ১ মাস, ৩ মাস এবং ৫ মাস পর ফলোআপ করা হয়। তাদের স্নায়বিক, হৃদযন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদযন্ত্রের জটিলতা (উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত হৃদকম্পন, বা পা ফুলে যাওয়া) এবং স্নায়বিক (পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা হাত ও পায়ে অসাড়তা, ঝিম ঝিম করা বা ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধের অস্বাভাবিকতা) জটিলতার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত গুরুতর কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের নিয়মিত ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করা সত্ত্বেও রক্তে অনিয়ন্ত্রিত শর্করার (ব্লাড সুগার) সম্ভাবনা যাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি তাদের তুলনায় ৯ থেকে ১১ গুণ বেশি ছিল এবং তাই যারা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তাদের বেশি ইনসুলিন প্রয়োজন হয়। একটি শঙ্কার বিষয় হলো, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল প্রতি ১,০০০ জনে ১০ জন। একইভাবে, কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে নতুন করে কিডনিজনিত জটিলতা (হাই ক্রিয়েটিনিন এবং প্রোটিনিউরিয়া) এবং লিভারজনিত জটিলতা (বর্ধিত লিভার এনজাইন) উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। আশস্ত করার মতো বিষয় হল, সময়ের সাথে সাথে উভয় গ্রুপের বেশিরভাগ জটিলতাগুলো হ্রাস পেয়েছে। তবে শ্বাসকষ্ট, দ্রুত হৃদকম্পন, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ইত্যাদির মতো কিছু সমস্যা রোগমুক্তির ৫ মাস পরেও মৃদু কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘদিনের কোভিড জটিলতা ও সমাধানের জন্য বিএসএমএমইউ'র শিক্ষক, চিকিৎসক এবং আইসিডিআর'বির বিজ্ঞানীদের এই যৌথ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন তিনি।
উপাচার্য বলেন, করোনা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। যাদের করোনা হয়েছে, আবার যাদের করোনা হয়নি তাদের নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বেশি আবার বাংলাদেশে অনেক কম কেন, সেটা নিয়েও গবেষণা হতে পারে। করোনা পারে না এমন কিছু নেই। করোনার কারণে মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। চোখের দৃষ্টিশক্তিতে প্রভাব ফেলেছে। হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলেছে। মানবদেহে বিদ্যমান রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের শারীরিক জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি তীব্র করেছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণার বিকল্প নাই। গবেষণার মাধ্যমে রোগের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যেমন সম্ভব, একইভাবে রোগ প্রতিরোধের উপায়ও জানা যাবে।
আইসিডিডিআর'বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ গবেষণার ফলাফলে গুরুত্বারোপ করে বলেন, কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ধরন নির্ণয়ে এই গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তারা যদি নিয়মিত ফলোআপ না করেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা গ্রহণ না করেন তবে এই গবেষণার সার্থকতা ম্রিয়মান হয়ে যাবে।
প্রফেসর ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকদের জন্য লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের অনুপস্থিতি প্রায়শই সহজে নির্ণয় করা যায় না এমন কোভিডের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলোর চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, প্রস্তাবিত গাইডলাইন চিকিৎসকদের সর্বাধিক সাফল্যের সাথে রোগ সনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে সহায়তা করবে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ ও লাইন ডাইরেক্টর, সিডিসি) অধ্যাপক ডা. মোঃ নাজমুল ইসলাম তার বক্তব্যে গবেষণাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির আহ্বান জানান। বক্তব্য রাখেন ইউএসএআইডি এর কর্মকর্তা সামিনা চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক ডা. মোঃ ফেরদৌস উর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, কার্ডিওলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ এবং আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভে বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী এবং প্রধান গবেষক ডা. ফারজানা আফরোজ গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলো উপস্থাপন করেন।