মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে বাঁকখালী নদী!
কক্সবাজারের কস্তুরিঘাট এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব কামাল উদ্দিন ২০১০ সালেও এখানে লবণের মাঠ দেখেছেন। সময়ের ব্যবধানে কাদামাটি, পলি জমে নদী বাঁক ভরাট হয়ে স্থল সৃষ্টি হয়েছে। আর সেখানে ব্লক দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে খাল। মাটি ফেলে সমতল করে নির্মাণ হয়েছে নানা স্থাপনা। হয়েছে পৌরসভার ময়লার ভাগাড়ও। নদীর গতি পরিবর্তন হওয়ার পর প্রভাবশালীদের দখল-দূষণে নদীটিকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীর বাসিন্দা ও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া তেরেঙ্গানুর (ইউএমটি) অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল দীর্ঘদিন বাঁকখালী নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "এই নদীর জীববৈচিত্র্যের মধ্যে সল্ট মার্শ এবং সি-গ্রাস অন্যতম। নদীর উপরিভাগ রামু ও বাংলাবাজার দিক থেকে দূষণ শুরু। এরপর পৌরসভার ময়লা পাম্পিং স্টেশন করার মাধ্যমে নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। নাব্যতা সংকট দূর করতে চালানো ড্রেজিং কার্যক্রমে অনেক ক্ষতি হয়েছে। নদীর গভীরতা বেড়েছে কিন্ত দুই পাশের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।"
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁকখালী নদীর দুই পাশের প্রায় ১৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শত শত স্থাপনা করেছে অবৈধ দখলদাররা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নদীর জমিতে করেছে ব্রীজ। পৌরসভা ময়লা ফেলে দখল প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করেছে।
৬ নম্বর ঘাট থেকে উত্তর নুনিয়াছড়া পর্যন্ত প্রায় ২৮টি অবৈধ জেটি রয়েছে বর্তমানে। সবকটিই অনুমোদনহীন। নদী থেকে বালু তুলে রাখার পাশাপাশি সিলেট থেকে পাথর ও বালু এনে বিক্রির জন্য মোট ৫টি সেল সেন্টার করা হয়েছে অবৈধভাবে। কয়েকটি তেলের বার্জও রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বরফকল, কোল্ড স্টোরেজ, ফিশিং অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ডকইয়ার্ড, মাছের আড়ত, শুঁটকির আড়তসহ শত শত বসতঘর। ৬ নম্বর ঘাটের পাশে করা হয়েছে ট্রাক স্ট্যান্ড।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপকূল রক্ষার জন্য এক দশক আগে লাগানো প্যারাবনও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এসব বনের মাঝখানে বালু বিক্রয় কেন্দ্র বা ব্যক্তিগত স্থাপনা করা হয়েছে। প্যারাবনের অন্তত ৪০ হাজার বাইন ও কেওড়াগাছ উজাড় হওয়ায় ২০০ প্রজাতির পাখির আবাসস্থলসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। উজাড় করা হয়েছে কয়েকশ একর প্যারাবন।
অবৈধ দখলের পাশাপাশি স্থানীয়রা অনেকে নদীর জমিকে নিজের বলে দাবি করছেন। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্রের মাধ্যমে কস্তুরিঘাট এলাকার নদীর বেশকিছু জমি ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ জরিপে (বিএস) রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে।
প্রায় ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁকখালী নদীর একসময় প্রশস্ততা ছিল ১২০ মিটার। কিন্তু দখলের কারণে প্রশস্ততা কমে কক্সবাজার শহরের কোথাও ৫০ মিটার, কোথাও ৬০-৭০ মিটার হয়ে গেছে।
যেভাবে কায়েম হলো দখলের রাজত্ব
নদীর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন দাবির বিষয়টি যাচাই এবং নদী দখলের পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে জাতিসংঘের রিমোট সেন্সিং এক্সপার্ট ড. আবু রুশেদ জামিল মাহমুদের সহায়তা নিয়েছিলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদক।
নাসার ল্যান্ডসেট ইমেজের ১৯৮৫ সালের ছবি এবং গুগল আর্থের ২০০৪ সালের পর থেকে ২০২২ সালের ছবি বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। তার ভাষ্য, ১৯৮৫ সালেও বর্তমান কস্তুরিঘাট এলাকাটিতে নদীর বাঁক ছিল। ২০০০ সালের দিকে এটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। পলি ও কাদামাটি জমে স্থলে রূপ নিয়েছিল স্থানটি। এটি নদীর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, "২০০৪ সালের ডিসেম্বরের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, কস্তুরিঘাট এলাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করতো। ছিল লবণের মাঠ। তখন প্রাকৃতিকভাবে কিছু ম্যানগ্রোভ হয়েছিল সেসময়। অর্থাৎ সেখানে ম্যানগ্রোভ হওয়ার সম্ভবনা ছিল। দখলের মাধ্যমে সেটিও নষ্ট করা হয়েছে। নির্মাণাধীন বাঁকখালী ব্রীজটি একসময় পুরোপরি নদী ছিল। ২০১৩ সালে পৌরসভা ময়লা ফেলা শুরুর মাধ্যমে নদী দখল শুরু করে। ২০১৬ সালে এখানে থাকা খালটির দু'পাশ বন্ধ করে মেরে ফেলা হয়। বন্ধ হয় পানির প্রবাহ। ২০১৫ সালের পর থেকে দখল শুরু হয় বড় এলাকাজুড়ে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পুরো কস্তুরিঘাট এলাকায় বালু ফেলে নদীর চিহ্ন পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করা হয়। এই সময়টায় বিশাল আকারে দখল হয়। এছাড়া খুরস্কুল ও নানিয়ারচরেও ১৯৮৫ সালে ম্যানগ্রোভ ছিল। এখানে ঘন বসতি গড়ে ওঠায় প্রকৃতির ক্ষতি হয়েছে।"
নদী দখল, অবকাঠামো নির্মাণসহ পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রকৃতির ক্ষতিসাধনের 'ক্লাসিক উদাহরণ' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ড. জামিল মাহমুদ।
এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি নদী বন্দর
প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২০১০ সালে বিআইডব্লিউটিএ-কে বাঁকখালী নদী বন্দরের সংরক্ষক নিযুক্ত করেছিল সরকার। নদী তীরবর্তী প্রায় ২৭০ একর ভূমি সংস্থাটিকে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু নদীতীরের জমিগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তা করেনি জেলা প্রশাসন। অভিযোগ আছে, নদীতীরের দখল, ইজারাসহ নানা কার্যক্রমকে ঘিরে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক লেনদেন সংঘটিত হয়। এজন্য নদী বন্দর প্রক্রিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছে সংশ্লিষ্টরা। আর এই সুযোগে দখলদাররা জেলা প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে দখল কার্যক্রম চালিয়েছে।
প্রজ্ঞাপনের পরও এই জমি হস্তান্তর না করায় মহেশখালীর নাগরিক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রায়হানুল মোস্তফা স্বপ্রণোদিত হয়ে ২০১৩ সালে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। রিটের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে ২০১৬ সালে রায় ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে নদী তীরভূমি বিআইডব্লিউটিএ-কে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়। সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। এর বিরোধিতা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আদালতে আপিল করে। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি আপিলটি খারিজ হয়। ফলে ৬০ দিনের মধ্যে ভূমি বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনাটি বহাল থাকে।
১৩১ দখলদারের মধ্যে মাত্র ২ জনকে উচ্ছেদ
২০২০ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় নদী দখলদার হিসেবে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী, ১৩১টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়।
নদীর জমি উদ্ধারে গত ২৮ ফেব্রুয়ারী ও ১ মার্চ অভিযান চালিয়ে ১৩১ জনের মধ্যে মাত্র ২ জনকে উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটএ। ওইসময় স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি নিজের জমি দাবি করে অভিযানে বাধা দেয়। স্থানীয়দের ভাষ্যে, 'মিডিয়া ডেকে অভিযানের নামে ঢাকঢোল পিটানো হয়েছে।'
বিআইডব্লিউটিএর উপপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) নয়ন শীল টিবিএসকে বলেন, "নদী বন্দরের জমি বুঝিয়ে দিতে বারবার জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। নদী বন্দর প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় এতো দখল হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। আশা করছি, জেলা প্রশাসন দ্রুত সময়ের মধ্যে জমি বুঝিয়ে দেবে।"
তিনি বলেন, "জেলা প্রশাসন অভিযান চালালে আমরা লজিস্টিক্যাল সহ সব ধরণের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।"
নদীর জমি কীভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান টিবিএসকে বলেন, "১৯৯০ সালের বিএস জরিপে নদীর জমি কীভাবে রেকর্ড করা হয়েছে, এতো বছর পর এসে তা উদঘাটন করা কঠিন। উচ্ছেদ অভিযানের পর দখলে থাকা ব্যক্তিরা আদালতে গিয়েছেন বলে শুনেছি। বাকিটা আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন।"
তিনি আরো বলেন, "বিআইডব্লিউটিএকে নদী বন্দরের জমি বুঝিয়ে দিতে আর কোন বাধা নেই। সরকারি ফি জমা দিয়ে বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে তাদের জমি বুঝিয়ে দেওয়া হবে। বাকি দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো করা হবে।"