দূষণের কারণে হালদা নদীতে মারা যাচ্ছে মা মাছ: বিশেষজ্ঞরা
গত ১২ দিনে চট্টগ্রামের হালদা নদীতে দুটি ডলফিন এবং ছয়টি মা কার্প মাছের মৃত্যু মাছচাষি ও গবেষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তারা মাছের মৃত্যুর জন্য ক্রমবর্ধমান দূষণকে দায়ী করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ নদীতে গৃহস্থালী ও শিল্প বর্জ্যের অনিয়ন্ত্রিত নিষ্কাশনের ফলে দূষণ পরিস্থিতি আরও বাড়ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য। উপমহাদেশে কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার পাহাড়ি ঝরনা থেকে উৎপন্ন হালদা।
'সাম্প্রতিক নমুনা নেওয়ার সময় আমরা নদীর মূল প্রবাহের পানির গুণমান ভালো দেখেছি। তবে নদীতে যুক্ত হওয়া খালের পানির গুণমান খুবই খারাপ। কারণ এগুলোতে আশপাশের শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্য মিশে আছে,' বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়া।
'এসব বিষাক্ত বর্জ্য হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্রের পানির বিভিন্ন ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যকে বদলে দিচ্ছে। নদী রক্ষার্থে হালদা দূষণের জন্য দায়ী কারখানাগুলো শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে,' তিনি টিবিএসকে বলেন।
মৎস্য অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে ৪৩টি ডলফিন এবং ৩০টি রুই ও কাতলা মা মাছ মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। গত ১৮ মাসে কোনো মাছ মরার খবর পাওয়া না গেলেও সম্প্রতি নদীতে মা মাছের মৃত্যু আকস্মিক বেড়ে গিয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তর এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এসব মাছের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য ১ জুলাই থেকে আলাদা আলাদা দুটি কমিটি গঠন করেছে।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে মৃত একটি মাছের ময়নাতদন্ত করা হবে। এছাড়া ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য মাছের নমুনা অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবেও পাঠানো হয়েছে।
একক নদী হিসেবে হালদা জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। এ নদীতে কার্প জাতীয় মাছের বৃদ্ধির হার অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক বেশি। তাই সারাদেশের ব্যবসায়ীরা হালদার পোনা কিনতে চট্টগ্রামে আসেন।
ডিম থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতের চারটি পর্যায়ে হালদা অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
গবেষকদের মতে, বাংলা মাসের চৈত্র ও আষাঢ়ের মধ্যবর্তী পূর্ণিমার রাতে বজ্রসহ বৃষ্টি হালদা নদীতে আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করতে পারে। অনুকূল তাপমাত্রা থাকলে কার্প মাছ সাধারণত এ সময় ডিম ছাড়ে। মা মাছ সাধারণত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত হালদা নদীতে ডিম পাড়ে।
মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, 'অনুকূল আবহাওয়া না পাওয়ায় চলতি মৌসুমে পুরোদমে ডিম ছাড়েনি মা মাছ। পেটে আসা ডিমগুলো ছাড়তে না পারলে সেগুলো নিজেদের শরীরে শুষে নেয় মা মাছ। ওই সময়টায় শারীরিকভাবে দুর্বল ও সংকটাপন্ন থাকে মা মাছ।'
'তখন ব্যাকটেরিয়া সহজেই সংক্রমণ করতে পারে মাছকে। যেভাবে নদীতে দূষণ বেড়েছে, জীবাণু সংক্রমণ স্বাভাবিক। ধারণা করছি, এ কারণেই মা মাছগুলোর মৃত্যু হয়েছে,' তিনি আরও বলেন।
দূষণ রোধে সরকারি তদারকি কমেছে
গবেষক ও হালদা নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, শিল্প ও গৃহস্থালির বর্জ্য সরাসরি হালদা নদীতে প্রবেশ করছে পাঁচটি খাল এবং দুটি বিল দিয়ে।
হালদা রক্ষায় আন্দোলনের কর্মী স্থানীয় বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম মুন্না টিবিএসকে বলেন, 'শহরের শিল্পকারখানা, গৃহস্থালি ও ট্যানারির বর্জ্য খন্দকিয়া ও কাটাখালী খাল দিয়ে সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ে। পোল্ট্রির বর্জ্যও নদীতে এসে পড়ে। জুনের শুরু থেকে এসব খালে পানি কালো; তেল, বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত দুর্গন্ধযুক্ত পানি দেখা যাচ্ছে।'
ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের মতে, ২০২২ সালের প্রথম ছয়মাসে হালদা নদীর তীরে দূষণবিরোধী ২৮টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। পরবর্তী ছয়মাসে অভিযানের সংখ্যা ছিল ২১টি।
২০২৩ সালের প্রথমার্ধে ১৫টি এবং শেষার্ধে ১০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের প্রথম ছয়মাসে মাত্র ১০টি অভিযান চালানো হয়েছে।
হাটহাজারীর হালদা মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র হ্যাচারির মালিক কামাল সওদাগর টিবিএসকে বলেন, 'প্রশাসনিক তদারকি জোরদার করা দরকার। ছোট মাছ ধরতে কিছু অসাধু ব্যক্তি বিষ প্রয়োগ করছে। এসব ছোট মাছ বিষ খেয়ে মারা যাওয়ার পর সেগুলো আবার বড় মাছে খাচ্ছে।'
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মসিউজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা গত তিনদিন ধরে সকল সংস্থা মিলে কাজ করছি। দূষিত পানি প্রবাহ বন্ধের বিষয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে জেলা প্রশাসনের কাছে।'
গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, 'পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন এবং মৎস্য অধিদপ্তরকে দূষণ রোধে কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে হবে। দূষণের জন্য দায়ী কারখানাগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।'