ঈদ আর মূল্যস্ফীতির মধ্যে জমেনি বৈশাখের বাজার
বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিকে ঘিরে সব সময় পোশাক, ফুল, মিষ্টি আর অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পণ্য বিক্রয়ের যে পসার দেখা যায়, এবার বাজার ঘুরে তা দেখা যায় নি। ঈদের কেনাকাটা আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মধ্যে জমে ওঠেনি এ বছর পহেলা বৈশাখের বাজার।
খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, ঢাকা ও অন্যান্য শহরে তীব্র দাবদাহ আর অস্বাভাবিক যানজটের কারণে মানুষজন কেনাকাটার জন্য ঘর থেকেই বের হতে চায় নি। এটাও পহেলা বৈশাখের ব্যবসা পড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পোশাক, জুতা ও অন্যান্য সাজসজ্জার প্রসাধনী বিক্রি হয় প্রায় এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার। এবার ঈদের কারণে সেটা হচ্ছে না। আবার ঈদের বিক্রিও তুলনামূলক কম হচ্ছে।"
তিনি যোগ করেন, "একে তো রোজা, সামনে ঈদ। তার ওপর অসহনীয় যানজট। মানুষের হাতে টাকা-পয়সার টান আছে, ক্রয়ক্ষমতা আগের থেকে কমেছে। আবার এবার পণ্যের দামও বেশি। এসব কারণে বৈশাখের বাজার তেমন জমেনি।"
ঈদের পাশাপাশি পহেলা বৈশাখে সর্বাধিক বিক্রয়ের আইটেম পোশাক হলেও, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসবের পোশাকের কালেকশন অধিকাংশ দোকানেই ছিল না। ঢাকাস্থ দেশি দশের সেলস এক্সিকিউটিভ মহসিন পারভেজ যেমন বললেন, "পহেলা বৈশাখের জন্য আমাদের কোন কালেকশন নেই, আমরা বরং ঈদকেই ফোকাস করছি। পহেলা বৈশাখের জন্য আইটেম খুঁজছেন, এমন খুব কমই কাস্টমার পেয়েছি আমরা।"
"তবে আমরা অনেক রঙিন পোশাক এবং শাড়ি এনেছি যা ঈদ ও পহেলা বৈশাখ দুই উৎসবেই পরা যেতে পারে," বলেন তিনি।
রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে আর্টিজানের সহকারী ব্যবস্থাপক জাহিদ হাসান বলেন, "আমাদের ঈদের জন্য বিশাল কালেকশন, কিন্তু বৈশাখের জন্য কম। আসলে এর পেছনে যুক্তি হলো, মানুষ তো আর ঈদ আর বৈশাখ দু'য়ের জন্য দ্বিগুণ খরচ করতে পারবে না।"
তিনি আর বলেন, "কাছাকাছি সময়ের মধ্যে এত বড় দুটি উৎসব সত্ত্বেও আমাদের বিক্রি এখনও অন্তত ২০% কম। মানুষের হাতে টাকা নেই, তারা কিনবে কী করে? তার ওপর গরম আবহাওয়া আর তীব্র যানজট- মানুষজন রোজার মধ্যে ঘর থেকেই বের হতে ইচ্ছুক নয়।"
পহেলা বৈশাখে মার্কেটগুলো পণ্যে নানান ছাড় দেয়। এবার সেরকম উল্লেখযোগ্য কোন ছাড়ও দেয়নি তারা।
বাংলা বর্ষের প্রথম দিন উপলক্ষে করপোরেট গিফটও দেয়া হত প্রচুর। তবে এবার দেশে সেই আয়োজনগুলোও ছিল অনেক কম।
পহেলা বৈশাখকে ঘিরে নববর্ষের দিনে পাড়ায়-মহল্লায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে আত্মীয়-স্বজন মিষ্টি, দই নিয়ে যান। এই দিনকে ঘিরে মিষ্টি-দইয়ের একটি বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। হালখাতাকে ঘিরে গ্রামাঞ্চলে প্রচুর মিষ্টি, মুড়ি, সন্দেশ, দই বিক্রি হয়। তবে এ বছর এসব খাতেও বেচাকেনার অবস্থা ভাল না।
শেওড়াপাড়ায় বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের ম্যানেজার তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, "আমরা পহেলা বৈশাখে প্রচুর মিষ্টির অগ্রিম অর্ডার পাই। সাধারণ বিক্রিও হয় প্রচুর। কিন্তু এবছর কী হলো, কিছুই বুঝতে পারছি না। অগ্রিম অর্ডার একেবারেই নেই। সাধারণ বিক্রিও ভাল না।"
প্রতিবছর গ্রামগঞ্জে, এমনকি শহরেও হয় বৈশাখী মেলা। সেখানে চুড়ি, মালা, দুল, মাটির তৈরি পণ্য, ডুগডুগিসহ কুটিরশিল্পের অনেক পণ্য তৈরি করেন ছোট পুঁজির উদ্যোক্তারা। কিন্তু রোযার কারণে এবছর সেগুলো বিক্রি নিয়েও আছে সংশয়।
কাপড়ের পুতুলের কারিগর জুলিয়েট বলেন, "এবার পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পুতুলের বাড়তি কোন চাহিদা নেই। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এত অর্ডার আসে যে আমাদের দিন-রাত কাজ করতে হয়।"
নববর্ষের দিনকে সামনে রেখে এপ্রিলের প্রথম দিন থেকে বিশাল চাহিদা তৈরি হয় পান্তা-ইলিশের। অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি করা ইলিশ-পান্তার সঙ্গে যেসব ছোট উদ্যোক্তা সম্পৃক্ত, তারাও পড়েছেন বিপাকে।
এছাড়া পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অন্তত ৬০ থেকে ১০০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হয়। সেখানেও নেই কোনো বাড়তি চাপ।
শাহবাগের আপন পুষ্প বিতানের মালিক সোহরাব হোসেন বলেন, "এবার মনে হচ্ছে মানুষের মধ্যে পহেলা বৈশাখ নিয়ে বাড়তি কোন উন্মাদনা নাই। প্রতিবছর এ সময়ে আমাদের ক্রেতার চাপে কথা বলার সুযোগ থাকে না। কিন্তু এবছর ফাঁকা।"