২ কোটি টাকা ব্যয়ে কংক্রিটের সৌন্দর্য বর্ধনে সাত মসজিদ রোডের কয়েকশো গাছ কেটেছে দক্ষিণ সিটি!
ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে উত্তর সিটি মেয়র দুই লাখ গাছ রোপণের ঘোষণা দিয়েছেন, অপরদিকে দক্ষিণ সিটি রাস্তার ডিভাইডারের কয়েকশ গাছ কেটে সেখানে কংক্রিটের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, সড়কটিতে যেসব গাছ ছিল সেগুলো মিডিয়ানের গাছের উপযোগী নয়। গাছগুলো রাস্তায় চলাচলকারী বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। বিভিন্ন সময় ঝড়ে গাছ ও গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে দুর্ঘটনা ও মানুষ আহতেরও ঘটনা ঘটেছে। এজন্য মিডিয়ান তৈরী করে ছোট ও মাঝারি আকারের ফুলের গাছ লাগাবে দক্ষিণ সিটি।
পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তার ডিভাইডারে গাছ রেখেও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা যেত। একসাথে একটি রাস্তার সব গাছ কেটে ফেলার মতো এমন নৃশংসতা আগে দেখেননি তারা। দ্রুত গাছ কাটা বন্ধ এবং কাটা গাছের স্থানে দেশি গাছ রোপণের দাবি তাদের।
একটি উন্নয়নমূলক কাজের প্রকল্পের অধীনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এ বছরের জানুয়ারিতে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের সড়কদ্বীপের গাছ কাটা শুরু করে। ৩০ জানুয়ারি বেশ কয়েকটি গাঠ কেটে ফেলার পরে এর প্রতিবাদ জানায় স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীরা। পরে ৩১ জানুয়ারি এর প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করে এ এলাকার শিশু, শিক্ষার্থী, পরিবেশবাদী, সমাজকর্মী, গবেষক, শিক্ষক, শিল্পীরা। তখন তারা সড়কে গাছ কাটা বন্ধ করে কাটা গাছের স্থানে ৭ দিনের ভেতর গাছের চারা লাগানোর দাবি জানায়। এর পরে রাস্তার ডিভাইডারের গাছ কাটা স্থগিত রাখে দক্ষিণ সিটি।
এ ঘটনার প্রায় তিন মাস পরে এসে ১ মে রাতে আবাহনী মাঠ সংলগ্ন সড়কদ্বীপের গাছগুলো কেটে ট্রাকে নিয়ে সরিয়ে ফেলে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা। পরে স্থানীয়দের বাধায় গাছ কাটা বন্ধ রাখে তারা। এর পরে দফায় দফায় প্রতিবাদ ও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসলেও দক্ষিণ সিটি মিডিয়ানের প্রায় এক হাজারের মতো গাছ কেটে ফেলে।
দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সড়কদ্বীপ, ফুটপাত, মিডিয়ান এবং পাবলিক টয়লেট নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে ৯.৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে গাছগুলো কাটা হচ্ছে।
মোট বাজেটের দুই কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সাত মসজিদ রোডের উন্নয়নে।
গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবার কথা রয়েছে চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে।
এদিকে সাত মসজিদ রোডে বিভাজকের গাছ কাটা বন্ধ এবং সেখানে পুনরায় বৃক্ষ রোপণের দাবি জানিয়ে সোমবার (৮ মে) সংবাদ সম্মেলন করেছে সাতমসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলন কমিটি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্মেলনে বলেন, "গত পাঁচ দিনে ধানমন্ডিতে যে তাণ্ডব দেখলাম, তা শুধু এই নগর প্রশাসন দ্বারাই সম্ভব। যে নগর প্রশাসন কারো কথা শোনে না।"
রিজওয়ানা হাসান বলেন, "একটি নগর প্রশাসনের কাছে মানুষ স্বস্তি আশা করে, শান্তি আশা করে। তবে এই নগর প্রশাসন নগরবাসীকে অশান্তি দিচ্ছে। তারা ধানমন্ডি এলাকায় আমাদের কারো কথা শোনেনি, কারো কথা মানেনি, নির্বিচারে গাছ কেটেছে।"
আন্দোলনের সমন্বয়কারী আমিনুর রাজী বলেন, "সাত মসজিদ সড়কে আগ্রাসী প্রজাতির গাছ খুব একটা নেই। গাছগুলো কোনোভাবেই সড়ক ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ নয়। এসব গাছকে রেখেই সড়ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তা করা হয় নি; রাতের আঁধারে গাছগুলো কাটা হয়েছে।"
মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, "১৯৬১ সাল থেকে ধানমণ্ডিতে আছি, তবে সব গাছ কেটে ফেলার মতো এমন নৃশংসতা আগে দেখিনি।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে সাত মসজিদ রোডে ৩০টি গাছ রয়েছে। সড়কের ঐতিহ্য হিসেবে গাছগুলো রক্ষায় আমরা কাজ করছি, রাতে পাহারা দেওয়া হচ্ছে।"
গত মঙ্গলবার গাছ কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদকে চিঠি দেয়া হয় ধানমণ্ডি এলাকাবাসী, ধানমণ্ডি সাত মসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলন কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং ব্রতীর পক্ষ থেকে।
চিঠিতে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের সড়কদ্বীপের গাছ নির্বিচারে না কেটে উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে এবং অবশিষ্ট গাছগুলো কাটা বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়।
গাছ কাটা বন্ধ ও যেসব স্থানে কাটা হয়েছে সেখানে নতুন করে বৃক্ষ রোপণে পদক্ষেপ নিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে চিঠি দিয়েছেন দেশের ৩৭ বিশিষ্ট নাগরিক। রোববার ডাকযোগে মেয়রকে চিঠি পাঠানোর তথ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব।
রাতে পাহারা দিয়েও ঠেকানো যায়নি গাছ কাটা
পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সাত মসজিদ সড়কে বিভাজক তৈরির জন্য গাছ কাটা অব্যাহত রাখে দক্ষিণ সিটি। গত এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলনের কারণে গাছ কাটতে রাতের আঁধারকে বেছে নেয় সিটি কর্পোরেশন। এজন্য রবিবার রাতে সড়কে পাহারা বসান এলাকাবাসী ও পরিবেশবিদরা।
রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাত মসজিদ সড়কে অবস্থান নেন তারা। এ সময় চলে প্রতিবাদী গান, বক্তৃতা ও পোস্টার লেখা। রাত দেড়টা পর্যন্ত চলে পাহারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি জানায়, আন্দোলনকারীরা অধিকাংশই চলে যাওয়ার পরে রাত তিনটার দিকে দক্ষিণ সিটির লোকজন বুলডোজার নিয়ে আবার আসে গাছ কাটতে। পরে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়।
অবস্থান কর্মসূচির সময় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, "সাত মসজিদ সড়ক বিভাজকের গাছগুলো কাটার জন্য সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার বাহিনীর তৎপর। ইতোমধ্যে ধানমণ্ডির জিগাতলা থেকে আবাহনী মাঠ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। আন্দোলনেও বন্ধ হয়নি গাছ কাটা। একটি দেশের নগর কর্তৃপক্ষ তার নাগরিকদের চোখে ধুলা দিতে এভাবে রাতের আঁধার বেছে নিতে পারে না। আমরা এখন গাছের জীবন বাঁচাতে রাতেও পাহারা দেব।"
যা বলছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দাবি, এ রাস্তাটির মিডিয়ান এতোদিন অপরিকল্পিত অবস্থায় ছিল ফলে রাস্তাটিতে যানজট লেগেই থাকতো। তাই মিডিয়ান থেকে বড় আকারের গাছ কেটে পরিকল্পিত মিডিয়ান তৈরী করে গাছ রোপণ করা হবে।
এ রাস্তার চলমান কাজের প্রকল্প পরিচালক এবং দক্ষিণ সিটির জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিবেশ) মোঃ খায়রুল বাকের টিবিএসকে বলেন, "এ রাস্তাটির মিডিয়ানে এতোদিন যে গাছগুলো ছিল সেগুলো অনেকটাই আগাছা। রাস্তার মিডিয়ানে এসব গাছ থাকার কারণে নানা সময়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গাছের ডালপালার কারণে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি হয়েছে। তাই এসব গাছ কাটার পরে মিডিয়ান তৈরী করে এর মাঝে নানা ধরনের ফুলগাছ ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ লাগানো হবে।"
তিনি বলেন, "আম, জাম, কাঁঠাল জাতীয় গাছ রাস্তার মিডিয়ানে লাগানোর গাছ নয়। এসব গাছ বিভিন্ন সময় বীজ পড়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে বেড়ে উঠেছে। তাই রাস্তার অধিকাংশ জায়গায় দুই পাশের রাস্তা অসমান ছিল, যা যানজট সৃষ্টি করতো। আমরা আগামী এক মাসের মধ্যেই এ রাস্তার মিডিয়ানে নানা জাতের বাগানবিলাসসহ ফুলগাছ লাগিয়ে দিবো। বড় আকারের কোনো গাছ লাগানো হবে না।"
দক্ষিণ সিটি কতোগুলো গাছ কেটেছে এমন প্রশ্নের জবাবে খায়রুল বাকের বলেন, "এসব অপরিকল্পিত গাছগুলোকে তো আর গাছ বলা যাবে না। দেখা গেছে শত শত জাম গাছ, শত শত আম গাছ। এগুলো তো এক বছর হলেই কাটা পড়ে। এসব গাছের কারণে অর্ধেক রাস্তা আনইউজড (অব্যবহৃত) থাকে।"
"শীঘ্রই আমরা এগ্রিকালচারাল অফিসার নিয়োগ দিচ্ছি যাদের পরামর্শে সুপরিকল্পিতভাবে গাছের চারা রোপণ করা হবে। আগে যারা মেয়র ছিলেন তারা হয়তো পরিকল্পিতভাবে এসব চিন্তা করেনি। মিডিয়ানের গাছ বড় হতে দিলেই সেটি বিপদ ডেকে আনবে।"
এবারে ১৩ হাজার গাছ দক্ষিণ সিটি এলাকায় লাগানো হবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, "১৩ হাজার গাছ লাগানোর টেন্ডার শেষ হয়ে গিয়েছে। মাটিতে একটু রস আসলেই গাছ লাগানো শুরু হবে। যার মধ্যে সাত মসজিদ রোডেও এসব গাছ লাগানো হবে। এমন ধরনের গাছ লাগাবো যা দেশি প্রজাতির এবং গাছে পাখি বসবে, ফুল দেখা যাবে।"