এসএসসি’র ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রির অভিযোগে গ্রেপ্তার ৪
চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের নামে প্রতারণা করে অর্থ আদায়ের অভিযোগে চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- আহমেদ রেজা খান রিজভী (২০), মো. আরমান (২২), মো. রিফাত (২৩) এবং মোহাম্মদ রাসেল তালুকদার (২২)।
বৃহস্পতিবার (১১ মে) রাতে নগরীর বাকলিয়া থানার কালা মিয়া বাজার এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মাহবুব আলম জানান, "গ্রেপ্তার চারজন সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এরা চলমান এসএসসি পরীক্ষার কথিত প্রশ্ন বিক্রি করে আসছিল। তারা মূলত পরস্পর যোগসাজশে আগের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে সেগুলো কম্পিউটারে এডিট করে কিছু পরিবর্তন আনে। এরপর চলমান এসএসসি পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী তারিখ বসায়।"
"সেগুলো ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে পরীক্ষার্থী কিংবা তাদের অভিভাবকের কাছে সরবরাহ করে টাকার বিনিময়ে।"
র্যাব কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, "এরা সরাসরি প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে পেরেছে, এমন নয়। পুরনো প্রশ্নপত্র এবং সাজেশন মিলিয়ে তারা নিজেরাই ভুয়া প্রশ্নপত্র বানিয়ে সরবরাহ করে টাকা আদায় করেছে। প্রশ্নপত্র ভুয়া হলেও অন্তত ৩০ শতাংশ কমন এসেছে। এতে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়িয়েছে।"
"অন্তত চারটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের নামে তারা এই প্রতারণা করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি," যোগ করেন তিনি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের 'গুজবের' মধ্যেই চক্রটিকে ধরতে অভিযানে নেমেছিল র্যাব ও নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
উভয় সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত চারজন নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান ছাত্র। চকবাজার কেন্দ্রিক কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা। এদের মধ্যে মূল হোতা আহমেদ রেজা খান রিজভী। মূলত বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে সাজেশন সংগ্রহ করে এর ভিত্তিতে ভুয়া প্রশ্নপত্র তৈরি করেছিল সে।
'প্রিন্স ধ্রুব' নামে ফেসবুকে পেইজ খুলে প্রকাশ্যে প্রশ্নপত্র বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিল রিজভী। সেখানে তিনটি পারসোনাল বিকাশ নম্বর দেওয়া ছিল।
৯ মে গণিত পরীক্ষার পর পেইজটি ডিঅ্যাক্টিভ করে দেওয়া হয়। একইভাবে মোবাইল নম্বরগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার চারজনের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইলে ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে নগরীর বাকলিয়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে।
ভুয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে আসল প্রশ্নপত্রের মিল
"৯ তারিখ গণিত পরীক্ষার মাত্র ১২ ঘন্টা আগে আমার এক ছাত্র ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে গণিতের হাতে লেখা প্রশ্নের কিছু ছবি শেয়ার করে, আমাকে সেগুলোর সমাধান করে দিতে বলে," নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, "আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি, কিন্তু পরে অবাক হয়েছি; কারণ ওই প্রশ্নের ৬টির মধ্যে ৩টিই পরের দিনের পরীক্ষায় এসেছে। তাছাড়া, বহুনির্বাচনী প্রশ্নগুলোর বেশিরভাগই হুবহু মিলে গেছে।"
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে একই কথা জানান।
বিভিন্ন প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপেও এরকম প্রশ্নপত্র ও উত্তরের নমুনা পাওয়া যায়। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড 'ব্যাচ ২৩ (সিইউএফএল)' নামে একটি গ্রুপ থেকে কিছু স্ক্রিনশটও পেয়েছে; যেখানে দেখা যায়, গণিতের প্রশ্নপত্রটি ৮ মে তারিখে রাত ৯টা ৩৯ মিনিটে আপলোড করা হয়েছিল। লিখিত এবং বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) পরীক্ষার প্রশ্নগুলো ছিল হাতে লেখা।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন মহেশখালী দ্বীপের বহু শিক্ষার্থীও পরীক্ষার দিন আগেই এসব প্রশ্নপত্র পেয়েছে।
সেখানকার বাসিন্দা শহিদুল হাসান বিশাল টিবিএসকে বলেন, "আমার ছোট বোন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। কয়েকদিন ধরে সে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কথা বলছিল। আমি গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু গণিতের দিন সে হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া কিছু প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে আসে। আমার কাছে সমাধান চাইলেও আমি সমাধান করে না দিয়ে পড়ায় মন দিতে বলি। কিন্তু পরদিন আমি লক্ষ্য করলাম রাতের হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া প্রশ্ন গুলোই হুবুহু সকালের প্রশ্নে এসেছে।"
নুরুল আবছার নামে এক শিক্ষার্থী টিবিএসকে জানান, মূলত পরীক্ষার অনেক আগ থেকেই কিছু বড় ভাই ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশ্ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় চুক্তি করে। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতে তাদের মাধ্যমে হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ খুলিয়েছিল। এবার গণিত পরিক্ষার আগে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার আগের দিন শিক্ষার্থীরা হাতেলেখা প্রশ্ন পেয়েছে।
তার দাবি, গণিত-ইংরেজি দ্বিতীয়সহ আরও বেশ কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে এই চক্রটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, "প্রশ্ন কীভাবে ফাঁস হয়েছে আমাদের জানা নেই। তবে এখন যেহেতু পরীক্ষা হয়ে গেছে তাই কিছু করারও নেই।"
"এসব প্রশ্ন চট্টগ্রাম থেকে ফাঁস হয়নি, বরং এতে বিজি প্রেসের কর্মকর্তা জড়িত বলে আমরা নানাভাবে শুনেছি। বিষয়টি ইতোমধ্যে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহীনিকে জানানো হয়েছে," যোগ করেন তিনি।