বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় আরও দীর্ঘ হবে লোডশেডিং
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি শনিবার (৩ জুন) রাজধানীতে এক কর্মসূচির আয়োজন করে। তবে দেশে চলমান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের (লোডশেডিং) কারণে বেশ কয়েকবার বাধার সম্মুখীন হয় সেই কর্মসূচি।
রাজধানীর এফবিসিসিআই কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলন চলাকালে পরপর দুইবার লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটে। এতে এফবিসিসিআই বোর্ডের সদস্য ও সাংবাদিকরা প্রায় ২০ মিনিট বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিলেন।
দেশের রাজধানীতেই যখন এমন অবস্থা, তখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে মন্তব্য করেন তারা। দিন-রাত মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন দেশের মানুষ।
কয়লা সংকটের কারণে ১,৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটিও সোমবারের (৫ জুন) মধ্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে; আর এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুতই উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পায়রা দেশের অন্যতম প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। তবে এই কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় গত ২৫ মে; এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের একটি অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
কয়লা ছাড়াও, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ধরনের জ্বালানি, যেমন- তেল, গ্যাসেরও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে; এতে দেশেজুড়ে আবারও শুরু হয়েছে তীব্র লোডশেডিং। চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে এমন ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে জনজীবন।
তাপপ্রবাহের মধ্যে দেশে চলমান লোডশেডিংয়ের বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় এই পরিস্থিতি আরও কয়েক দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
দেশের কিছু কিছু স্থানে তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে। এরমাঝে লোডশেডিংয়ের জন্য জনদুর্ভোগের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, "আমরা সত্যিই দুঃখিত যে, এমন পরিস্থিতিতেও আমাদের লোডশেডিং সহ্য করতে হচ্ছে; এবং দুর্ভাগ্যবশত এই পরিস্থিতি আরও কিছুদিন চলবে।"
শনিবার (৩ জুন) সাভারে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এনার্জি রিসার্চ ল্যাবরেটরি অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদার বিপরীতে ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দেশে লোডশেডিংয়ের প্রকৃত পরিমাণ দৈনিক ২,০০০ থেকে ২,৫০০ মেগাওয়াটেরও বেশি।
বিপিডিবি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক ১৫,৫০০ থেকে ১৬,০০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ২৩,৪৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দেশে উৎপাদন হচ্ছে ১৪,০০০ থেকে ১৪,৫০০ মেগাওয়াটের মতো। ফলে চাহিদার তুলনায় দৈনিক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ মেগাওয়াট।
নসরুল হামিদ বলেন, বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু না থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা তীব্র হয়েছে।
বর্তমানে, দেশে মোট ৬৪টি ফার্নেস অয়েল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর সম্মিলিত সক্ষমতা ৫,৯৭৩ মেগাওয়াট। তহবিল সংকটের কারণে যখন বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই এই প্ল্যান্টগুলোর প্রায় অর্ধেকই আংশিক সক্ষমতায় চলছে।
এছাড়া, ২,৬৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৭টি কয়লা-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে দেশে। তবে কয়লা ঘাটতির কারণে এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সীমা ১,৪০০ মেগাওয়াটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, "এখানে আমরা সিস্টেম থেকে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ পাচ্ছি না, যে কারণে জনদুর্ভোগ ও লোডশেডিং বেড়েছে বলে আমি মনে করি।"
"আমরা এখন তেল পেতেও হিমশিম খাচ্ছি। ফলে বেশিরভাগ শিল্পে আমাদের গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
বন্ধ পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র
পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্টের দুটি ইউনিট পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন। প্ল্যান্টটির মালিকানার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (পিভিটি) লিমিটেড ২০১৮ সালে শুরু থেকেই ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করে আসছে।
তবে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (পিভিটি) লিমিটেড চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কয়লা আমদানির বিল বাবদ সরবরাহকারীদের কাছে ৩৯০ মিলিয়ন ডলার দেনা রয়েছে।
বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় সরবরাহকারীরা বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (পিভিটি) লিমিটেডকে কয়লা সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে কারখানা।
এদিকে, প্রচণ্ড গরমে প্ল্যান্টটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুতের ঘাটতি আরও তীব্র হয়েছে। এই প্ল্যান্ট জাতীয় গ্রিডে দৈনিক প্রায় ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বরিশাল, গোপালগঞ্জ ও ঢাকা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তাই সরবরাহের ঘাটতিতে এসব এলাকার মানুষ তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছেন।
পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট টিপিপি'র প্ল্যান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মওলা অবশ্য বলেছেন, কয়লা আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে; কারণ বকেয়া বিলের প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যেই পরিশোধ করেছেন তারা।
"আমরা ২৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে প্ল্যান্টটি পুনরায় চালু করতে পারবো বলে আশাবাদী," বলেন তিনি।