চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত কোরবানির পশু থাকলেও দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় ক্রেতা-বিক্রেতারা
গো-খাদ্যের দাম বাড়ার ফলে পশুপালনের খরচও বেড়েছে। ফলে, কোরবানির পশুতে বিনিয়োগকৃত টাকা তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে চট্টগ্রামের খামারিরা; সামর্থ্য অনুযায়ী কোরবানির পশু কিনতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত ক্রেতারাও।
"কোরবানিকে সামনে রেখে গত চারবছর খামারে গরু স্বাস্থ্যবান করেছি, মুনাফাও হয়েছে। কিন্তু গত একবছরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে পশুখাদ্যের দাম। ফলে বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হবে কোরবানির পশু। কিন্তু দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে কাক্ষিত মূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি।"
সম্প্রতি নিজ খামারে দাঁড়িয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কথা গুলো বলছিলেন চান্দগাঁও ফরিদাপাড়া এলাকার খামারি মোহাম্মদ সোহেল।
খামারিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খামার পর্যায়ে গত বছর ছোট ও মাঝারি আকৃতির গরুর (৩ থেকে ৫ মণ) মণপ্রতি দাম ছিল ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা এবং বড় গরু (৫ মণের উপরে) মণপ্রতি ২৭ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এ হিসাবে ৫ মণের (প্রায় ২০০ কেজি) গরুর দাম ছিল প্রায় ১.৬ লাখ টাকা।
এ বছর ছোট ও মাঝারি আকৃতির গরু (৩ থেকে ৫ মণ) মণপ্রতি ৩৫ থেকে ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় গরু (৫ মণের বেশি) বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৩৩ থেকে ৩৬ হাজার টাকায়। সে হিসাবে এ বছর ৫ মণের গরুর দাম হয়েছে ১.৯ লাখ টাকা।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার চট্টগ্রাম নগর ও ১৫ উপজেলার খামারিরা ব্যক্তিগতভাবে ও বিভিন্ন কৃষকের খামারে ৮ লাখ ৪২ হাজার ১৬৫ টি কোরবানির পশু মোটাতাজা করেছেন।
জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭১৩টি। সে হিসেবে পশুর ঘাটতি রয়েছে ৩৫ হাজারের বেশি।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলায় প্রতিবছর ১৫ শতাংশের বেশি কোরবানি বৃদ্ধি পেলেও, গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় গরুর উৎপাদন কমেছে ৮ হাজার ৪৭৮টি।
খামারিরা বলছেন, চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে গরুর উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রভাব বাজারে পড়বে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পশুর যে সামান্য ঘাটতি রয়েছে সেটা বগুড়া, দিনাজপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বেপারীদের গরু দিয়ে পুরণ হবে। তবে দাম থাকবে খুব বেশি।"
তিনি বলেন, "প্রতিমণ গরুর মাংসের দাম পড়বে ৪৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। আশঙ্কা করছি গতবারের চাইতে ২০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পাবে কোরবানীর পশুর।"
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও নগরের বেশ কয়েকটি খামার ও হাট ঘুরে দেখা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে খামারি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ বছর বড় গরুর তুলনায় ছোট ও মাঝারি গরু পালনে বেশি মনযোগী খামারিরা।
কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার তরুণ খামারি ইমজিয়াজ রায়হান টিবিএসকে বলেন, "গত বছর ৭০টি গরু বিক্রি হলেও আশানুরূপ দাম পাইনি। এ বছর তাই মাত্র ৩০টি গরু মোটাতাজা করেছি।"
"ইতোমধ্যে ক্রেতারা খামারে আসতে শুরু করেছেন, কিন্তু দামে মিলছেনা কারো সঙ্গে। পশুখাদ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, ক্রেতারা সেটা বুঝতে চাইছেন না," বলেন তিনি।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা প্রবীণ বাসিন্দা মোতালেব হোসেন টিবিএনকে বলেন, "সারাবছর সংসারের খরচের থেকে সঞ্চয় করে একটা ছোট গরু নিজেই কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করি। ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে গরু কিনি। এ বছর এই টাকায় কোরবানির পশু কিনতে পারবো কি না তা নিয়ে সংশয় আছে।"
পশুর দাম বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব ডা. নাহিদ রশিদও। তিনি সম্প্রতি গরুর খামার পরিদর্শনকালে গণমাধ্যমকে বলেন, আসন্ন ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে দেশে ১২.৫ মিলিয়ন গবাদিপশুর মজুদ রয়েছে। পরিমাণে পর্যাপ্ত হলেও এ বছর গবাদিপশুর দাম ১০ শতাংশ বাড়তে পারে।
খামারিরা বলছেন, ভুট্টাসহ নানা উপাদানের দাম বাড়ায় পশুখাদ্য উৎপাদনকারী (ফিড মিল) প্রতিষ্ঠানগুলো খাদ্য উৎপাদন কমিয়েছে। ফলে পশুখাদ্যের দাম দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। তাই কাঙ্ক্ষিত দাম পেতে অবৈধ পথে আসা বিদেশি পশু বিক্রি বন্ধের দাবি করেছেন খামারি ও ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রামে খামারে বাড়ছে পশু মোটাতাজাকরণ
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের গত আট বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত আট বছরে চট্টগ্রামে পশু উৎপাদন বেড়েছে ৩৮ শতাংশের বেশি।
প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত তিন বছরে দেশে পশু মোটাতাজা করা খামারের সংখ্যা বেড়েছে ১২ গুণ।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, "কয়েক বছর আগে যখন দেশের বাইরে থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়, তারপরই হৃষ্টপুষ্টকরণকৃত দেশীয় পশুর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এতে খামারিরা ভাল দামও পান। প্রবাস ফেরত ও শিক্ষিত যুবকরা পশু হৃষ্টপুষ্টকরণের দিকে ঝুঁকছেন। এ অবস্থায় পশুখাদ্যের দাম কমাতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।"