উপসর্গ বদলে যাওয়ায় ডেঙ্গুরোগ শনাক্ত কঠিন হয়ে পড়ছে
গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৮২০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, যা এ বছর এক দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃতের হার বাড়ার পাশাপাশি বদলে গেছে ডেঙ্গুর উপসর্গ। লক্ষণ বদলে যাওয়ায় ডেঙ্গু যে হয়েছে সেটি বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে যেতে দেরি করছেন রোগীরা। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়ায় রোগী দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে, অনেকেই মারা যাচ্ছেন।
ডেঙ্গুর লক্ষণ বদলে যাওয়ায় যেকোন ধরণের শারিরীক অসুস্থতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি ডেঙ্গু মোকাবেলায় মশা নিধন ও ব্যক্তিগত সতর্কতা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
তীব্র জ্বর, শরীরে তীব্র ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে র্যাশ- ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণ। তবে চলতি বছর এসব উপসর্গের বাইরে এমন সব লক্ষণ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, যা ডেঙ্গুর প্রথাগত উপসর্গ নয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের এসব উপসর্গ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, "এবার অল্প জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যথার দুই-তিন দিনের মধ্যে রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। অনেকই অজ্ঞান হয়ে যায়, পালস-ব্লাড প্রেশার পাওয়া যায় না, এটিকে ডেঙ্গুর মডিফাইড ফর্ম বলে। এই সমস্যাগুলো আমাকে একটু ভাবিয়ে তুলছে। নরমাল লক্ষণগুলো বদলে যাওয়ায় রোগী বুঝতে পারে না, দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছে।"
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, "এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, ব্যথা হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু টেস্টে পজিটিভ আসলে ৯০% ডেঙ্গু রোগী বাড়িতে থেকে ডাক্তারের পরামর্শমত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবে।"
''তবে বমি, খেতে না পারলে, প্রেশার কমলে হাসপাতালে যেতে হবে। ডায়বেটিস, হার্টের রোগী বা অন্য কোন কোমর্বিডিটি আছে এমন বা বয়স্ক লোক, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ডেঙ্গু পজিটিভ হলেই হাসপাতালে যেতে হবে", বলেন তিনি।
এ বছর রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে।
এ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, "এ বছর ডায়রিয়া, অল্প জ্বর বা জ্বর না থাকা, দুই-তিন দিন ধরে বমি, মস্তিষ্কে প্রদাহ, বুকে এবং পেটে পানি জমে যাওয়া, অসহ্য রকমের পেট ব্যথাসহ বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ নিয়ে আসছে রোগীরা। যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তারা এসব লক্ষণ নিয়ে আসছে। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটি বড় অংশ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত এবং এদের জটিলতা বেশি।"
তিনি আরো বলেন, "এবার মাল্টি-অরগান ডিসফাংশন সিনড্রোমের রোগী আমরা অনেক পাচ্ছি। এই ধরণের রোগীদের সরাসরি আইসিইউতে পাঠাতে হচ্ছে।"
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বলেন, "এডিস মশার ধরন যেমন বদলে যাচ্ছে তেমন ডেঙ্গুর লক্ষণেও আমরা পরিবর্তন দেখছি। এবার যাদের ডেঙ্গু হচ্ছে তাদের অধিকাংশরই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত। এদের জটিলতা যেমন তীব্র, উপসর্গগুলোও ভিন্ন।"
শিশুরা জ্বরের পাশাপাশি বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বেশি
শিশু ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে এবার ডায়রিয়া ও বমি নিয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে যাচ্ছে।
মাতুয়াইলের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথের শিশুরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানিয়া ইসলাম বলেন, "আগে শিশুদের ডেঙ্গু হলে জ্বর নিয়ে বেশি রোগী আসতো। একটু বড় বাচ্চাদের মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হতো, খেতে চাইতোনা। বমিও হতো তবে লুজ মোশন তেমন পাওয়া যেতো না। এবার বমি ও লুজ মোশন বেশি পাচ্ছি।"
শিশুদের ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষিত রাখতে অভিভাবকদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন ডা. তানিয়া ইসলাম। তিনি বলেন, "বাসার আশেপাশে পরিষ্কার রাখতে হবে। বাচ্চা দুপুরে যদি ঘুমায় মশারি দিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে।"
''যদি কোন কারণে বাচ্চার জ্বর চলে আসে তাহলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে না খাইয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। যদি আর্লি ডায়াগনোসিসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় তাহলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয়, বাচ্চার অবস্থার অবনতির ঝুঁকি কমে", যোগ করেন তিনি।
মশা নিধন বেগবান করতে হবে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়া ভালো লক্ষণ নয়। রোগী কমাতে হলে মশা মারতে হবে, মশা যাতে ডিম না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন সেটি করবে। মশা মারার কাজটি আরো বেগবান করতে হবে তা না হলে রোগী বাড়তেই থাকবে।"
''রোগী আসলে তো আমরা ফেরত দিতে পারিনা। সরকারি হাসপাতারে তো সীমাবদ্ধতা আছে। অতিরিক্ত বিছানা দিয়ে আমরা এমনিতেই রোগীদের চিকিৎসা দেই। ডেঙ্গুর মতো কোন রোগ হলে চাপটা আরো বেড়ে যায়'", বলেন তিনি।
ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, "উপসর্গ যাই হোক না কোনো একটু সন্দেহ হলেই হাসপাতালে যেতে হবে, ডাক্তার দেখাতে হবে। কিন্তু মানুষ দেরি করে হাসপাতালে যাচ্ছে বলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।"
এদিকে শনিবার ডিএনসিসির মাসব্যাপী বিশেষ মশক নিধন অভিযানের প্রথম দিনে দশটি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে লার্ভা পাওয়ায় ১৭টি মামলায় মোট ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।