আরও সময় চায় ঠিকাদার, সেপ্টেম্বরে বিআরটি চালু অনিশ্চয়তায়
দফায় দফায় সময় বাড়ানো পরেও বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০.৫ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ফলে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সেপ্টেম্বরে বিআরটি সেবা চালু করা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় পড়েছে সরকার।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের সেতু বিভাগের আওতায় ৪.৫ কিলোমিটার উড়াল অংশের প্রায় ১৬ শতাংশ এবং ১৬ কিলোমিটার অ্যাট গ্রেড অংশের প্রায় ১১ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে।
উড়াল অংশের কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন এবং অ্যাট গ্রেড অংশের কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে উড়াল অংশের চুক্তির মেয়াদ আরও দুই মাস এবং অ্যাট গ্রেড অংশের চুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জিয়াংসু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড চায়না এবং চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিজিজিসি)।
এদিকে প্রস্তাব অনুযায়ী, মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্রে জানা গেছে।
একইসঙ্গে, সড়ক অংশের প্যাকেজের ব্যয়ও ৪৭ শতাংশের বেশি বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
এছাড়া, প্রকল্পের দুই ফ্লাইওভারের প্রযুক্তি নির্ধারণের কাজ চূড়ান্ত না হওয়ায় নির্মাণ কাজ শেষ হতে বাড়তি সময় লাগবে বলেও মনে করছেন তারা।
বিআরটি প্রকল্পের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, "ঠিকাদারদের প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন এখনও হয়নি। সব মিলে কোনো কোনো অংশের কাজ শেষ হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।"
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সেপ্টেম্বর নাগাদ সম্পূর্ণরূপে বিআরটি সার্ভিস চালু করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
২০১২ সাল থেকে বিআরটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এই সময়সীমা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২,০৪০ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে উন্নীত করা হয়েছে ৪,২৬৮ কোটি টাকায়।
যেভাবে বাড়ছে চুক্তির মেয়াদ
৪.৫০ কিলোমিটার উড়াল সড়ক ও টঙ্গী সেতু নির্মাণের পাশাপাশি ছয়টি বিআরটি স্টেশনের কাজ করতে ৯৩৫.১৩ কোটি টাকার চুক্তির আওতায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করে জিয়াংসু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড চায়না।
৯১৬ দিনের চুক্তির আওতায় ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও প্রথম দফায় একই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে দুই দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়ে ২০২১ সালের আগস্ট ও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সেই মেয়াদ শেষ হলে পঞ্চম বারের মত চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত।
৯১৬ দিনের কাজ শেষ করতে ইতোমধ্যেই পার হয়েছে ২,০২৩ দিন। চুক্তির মেয়াদ বাড়লে কাজ শেষ হতে মোট ২,০৮৫ দিন বা মূল চুক্তির ২.২৮ গুণ সময় লাগবে।
অন্যদিকে, ৮৫৫.৩৮ কোটি টাকার চুক্তিতে ১৬ কিলোমিটার অ্যাট গ্রেড বিআরটি নির্মাণে সড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি ৭টি ফ্লাইওভার, ১৯টি বিআরটি স্টেশন, ২টি টার্মিনাল ও ২৫ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে।
৯১৬ দিনের চুক্তির মেয়াদ পাঁচ দফায় চলতি জুলাই পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয় চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিজিজিসি)। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী কাজটি শেষ হতে সময় লাগবে ২,৪৫৩ দিন, যা মূল চুক্তির ২.৬৮ গুণ।
সম্প্রতি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভায় জানানো হয়েছে, প্রকল্পের সেতু কর্তৃপক্ষের অংশে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ ১৩ শতাংশ বাকি আছে। ফ্লাইওভারের পাইল, পাইল ক্যাপ, পিয়ার স্থাপনের কাজও কিছুটা বাকি রয়েছে। ছয়টি স্টেশন নির্মাণের কাজে অগ্রগতি হয়েছে ২৭ শতাংশ।
সওজ অংশেও ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ কিছুটা বাকি আছে। ১৯ বিআরটি স্টেশনের কাজে অগ্রগতি হয়েছে ৫৬ শতাংশ। ১৫ ফুটওভার ব্রিজের অগ্রগতি হয়েছে ৫৫ শতাংশ। এছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়কের পেভমেন্টের কাজও কিছুটা বাকি রয়েছে।
বাড়ছে অ্যাট গ্রেড অংশের ব্যয়
প্রকল্প অনুমোদনের এক দশকের বেশি সময় পরে অ্যাট গ্রেড অংশের কাজের ব্যয় ৪৭ শতাংশের বেশি বাড়ছে। শুরুতে ৮৫৫.৩৬ কোটি টাকায় কাজটি করার কথা থাকলেও এখন এতে ১,২৫৯.৪৩ কোটি টাকা দাবি করছে ঠিকাদার। সেই হিসাবে এই অংশে ব্যয় বাড়ছে ৪০৪.০৬ কোটি টাকা।
সওজ অংশের প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সময়ের ব্যবধানে চুক্তিতে বেশ কিছু নতুন কাজ যোগ করা হয়েছে। আবার অপ্রয়োজনীয় কিছু কাজ বাদ দেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি উপকরণের ব্যয় বৃদ্ধির কারণেও ব্যয় কিছুটা বাড়ছে।
তিনি আরও জানান, "চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ও প্যাকেজের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে (এডিবি) পাঠানো হয়েছে। এডিবির সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে চুক্তির মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি ও প্যাকেজের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
তিনি অবশ্য জোর দিয়ে বলেন, ঘোষণা অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
দুই উড়াল সড়কেও জটিলতা
গাজীপুর চৌরাস্তা ও ভোগরায় প্রকল্পের দুইটি ফ্লাইওভারের প্রযুক্তি নির্ধারণে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে সওজ সূত্রে জানা গেছে।
প্রকল্পের পিআইসি সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, গাজীপুর চৌরাস্তার ফ্লাইওভারে 'ব্যালেন্স ক্যান্টিলিভার সাপোর্ট' ব্যবহার করা হবে কিনা, এ বিষয়ে এখনও কাজ করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। আর ভোগরা বাইপাসে 'মেকানিক্যালি স্ট্যাবিলাইজড আর্থ রিটেইনিং ওয়াল (এমএসই)' ব্যবহার নিয়েও এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে পিলারের ব্যবহার কমাতে 'ব্যালেন্স ক্যান্টিলিভার সাপোর্ট' ব্যবহার করা হয়। সড়কের ব্যস্ত মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণে এই সাপোর্ট তুলনামূলক যৌক্তিক হলেও এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে বাড়তি সতর্কতা দরকার।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, "প্রচলিত পদ্ধতিতে গাজীপুরের মত ব্যস্ত এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করলে ভোগান্তি বাড়বে। এই বিবেচনায় 'ব্যালেন্স ক্যান্টিলিভার সাপোর্ট' এর মত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারই যৌক্তিক। তবে এটা করতে গিয়ে প্রকল্পের কাজ আর বিলম্বিত করা যৌক্তিক হবে না।"
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ বলেন, "বড় এবং জটিল প্রকল্পে এ ধরনের কিছু ট্যাকনিক্যাল ইস্যু সবসময় থাকে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।"
এছাড়া, গাজীপুর উড়াল সড়কটির কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শাস্তি হয় না ঠিকাদারের
২০২০ সালের জুনে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, প্রাক্বলিত ব্যয়ের ২৭.৩৯ শতাংশ কম দামে উড়াল অংশের কাজটি নিয়েছিল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। আর সড়ক বিভাগের কাজটি নিয়েছিল প্রাক্বলনের ৬.৫২ শতাংশ কম দরে।
কম দামে কাজ নিয়ে ঠিকাদার কাজ শেষ করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের যোগান দিতে পারেনি। প্রতিমাসে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতেও ব্যর্থ হচ্ছে তারা। এ কারণে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল প্রতিবেদনে।
তবে এর তিন বছরের বেশি সময় চলে গেলেও কোনো ঠিকাদারকেই শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের সেতু অংশের পরিচালক মহিরুল ইসলাম খান বলেন, শুধু ঠিকাদারের কারণে কাজে বিলম্ব হলে জরিমানা আরোপ করা যায়।
"কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাস্তা থেকে বিভিন্ন সেবা সরাতে সময় লেগেছে। তাদেরকে সময়মত জমিও বুঝিয়ে দেওয়া যায়নি। মাঝে কোভিডের কারণেও কাজে ধীরগতি এসেছে," যোগ করেন তিনি।
যদিও সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার পরামর্শ দেন।