টাঙ্গাইলে ফিলিপাইনের এমডি-২ জাতের আনারস চাষ, রপ্তানির আশায় কৃষকরা
টাঙ্গাইলের মধুপুরে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হয়েছে আনারসের বিশ্ব সমাদৃত জাত ফিলিপাইনের এমডি-২। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও সঠিক সময়ে চারা রোপণ করায় ফলনও ভাল হয়েছে অনেক। এই আনারস দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে পারায় রপ্তানির আশাও করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
ফলে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে বিপুল অঙ্কের টাকায় বিদেশ থেকে কেনা চারাগুলো স্থানীয় কৃষকদের বিনামূল্যে বিতরণ করেছে কৃষি বিভাগ। রপ্তানি প্রক্রিয়া চলমান আছে বলেও জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগ কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এই এমডি-২ আনারস স্বাদে অনন্য। প্রাকৃতিকভাবেই লম্বা সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায় এই আনাসর।
দেশে উৎপাদিত আনারস পাকার পর তা সপ্তাহখানেক পর্যন্ত ভালো থাকলেও এমডি-২ আনারস ভালো থাকে প্রায় এক মাস।
এছাড়া, অন্য জাতের আনারসে চেয়ে এই জাতের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম এবং ফলনও অনেক ভাল হয়।
স্থানীয়রা জানান, মধুপুর উপজেলার পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে আনারস উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতিবছর শুধু মধুপুর উপজেলাতেই আনারস উৎপাদন হয় প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে।
উৎপাদিত জলডুঙ্গি ও ক্যালেন্ডার জাতের আনারস দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে না পারায় টানা বৃষ্টিতে লোকসান গুনতে হয় কৃষকদের। তাই খরচ কমানোসহ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের মাধ্যমে রপ্তানি করা, যায় এমন জাতের আনারস উৎপাদনের পরিকল্পনা করে সরকার।
এরই অংশ হিসেবে ফিলিপাইনের এমডি-২ জাতের আনারসের চারা বিতরণ করা হয় কৃষকদের মাঝে। এই আনারস প্রক্রিয়াজাতকরণ করে রপ্তানির মাধ্যমে মধুপুরকে প্রকৃতই 'ক্যাপিট্যাল অব পাইনাপেল' এ পরিণত করার উদ্যোগ নেয় সরকার।
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, মধুপুর উপজেলার ২২৭ জন কৃষকের মাঝে প্রায় ৮ লাখ ৬০ হাজার চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
সরেজমিন উপজেলার মহিষমারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা আনারস বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ছানোয়ার হোসেন এক বিঘা জমিতে এমডি-২ জাতের আনারস চাষ করেছেন।
তিনি বলেন, "আগে শুধু শুনতাম পৃথিবীতে যতগুলো উন্নত জাতের আনারস আছে, তারমধ্যে এমডি-২ জাতের আনারস সেরা। দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করায় এটি বিভিন্ন দেশেও রপ্তানিও করা যায়। মধুপুরের আনারস চাষীদের সমৃদ্ধ করতে কৃষিমন্ত্রী প্রতি চাষীকে পাঁচ হাজার করে চারা এনে দিয়েছেন। যেভাবে শুনেছিলাম, সেই মতোই ফলন অনেক ভাল হয়েছে। মিষ্টিও অনেক। আমরা আশাবাদী বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাষীরা যেমন আনারস রপ্তানি করে বৈদাশিক মুদ্রা আয় করে, ঠিক তেমনি আমরাও আয় করতে পারবো।"
"মধুপুরের মাটি আনারস চাষের জন্য অন্যতম। বিশ্বের অন্য দেশে এমডি-২ জাতের আনারস এক কেজির উপরে হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে দেড় কেজি পর্যন্ত হয়েছে," যোগ করেন তিনি।
অপর চাষী মো. শিমুল সরকার বলেন, মধুপুরে ক্যালেন্ডার ও জলডুঙ্গি নামের আনারস চাষ হয়। কিন্তু ক্যালেন্ডার ও জলডুঙ্গির চেয়ে এমডি-২ অনেক টেকসই একটি আনারস।"
"অন্য আনারস বর্ষার সময় তিন-চার দিনে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এমডি-২ এক মাসের অধিক সময় সংরক্ষণ করা যায়। আমারা অনেক ভালো ফলন পাচ্ছি। আমাদের দেখাদেখি আরও অনেকেই এই আনারস চাষ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে," বলেন তিনি।
চাষীরা আরও জানান, অন্য জাতের চেয়ে এই আনারসটি খেতে অনেক সুস্বাদু। অন্য আনারস খেলে অনেক সময় মুখে জ্বালাপোড়া করে, কিন্তু এমডি-২ আনারসে তা করে না। এছাড়া, এই আনারস চাষে খরচও অনেক কম।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলার ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসে চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ক্যালেন্ডার জাতের আনারস চাষ হয়েছে ৪ হাজার হেক্টরের উপরে। এবারই প্রথম ২২ হেক্টরের উপরে জমিতে এমডি-২ জাতের আনারস চাষ করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই আনারস কাতারে রপ্তানি করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, "সাধারণ অন্যসব আনারস উৎপাদন হয় হেক্টরপ্রতি ৩৮ থেকে ৪০ মেট্রিক টন। কিন্তু এমডি-২ জাতের আনারস উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে হেক্টরপ্রতি ৪০ থেকে ৪৫ মেট্রিক টন।"
সম্প্রতি আনারসের বাগান পরিদর্শন করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল হক পাটোয়ারী বলেন, "মধুপুরে যে পরিমাণ আনারস উৎপাদন হয়, কৃষকরা বাজারজাত করতে না পারায় সেই রকম দাম পেতেন না। অনেক আনারস নষ্ট হয়ে যেতো। টেকসই না হওয়ায় স্থানীয় আনারস আমরা রপ্তানি করতে পারিনি।"
"মাঠে যে আনারসের উৎপাদন দেখলাম, তাতে কৃষিমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে বলে আমি আশা করছি," যোগ করেন তিনি।