নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে না, বৃষ্টির অভাবই কারণ; বলছেন মৎস্যজীবী ও গবেষকরা
পুরো আষাঢ়ে ভারী বৃষ্টি ছিল না। শ্রাবণ মাসে মাত্র ২ দিন ৩-৪ ঘণ্টা মাঝারি বৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে মেঘনায় ইলিশের বিচরণ কমে গেছে। তাই নদীতে ইলিশের আকাল।
ফলে জেলে ও মাছের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পেশার মানুষেরা কষ্টে আছে। একই কারণে দেশের মানুষও কম দামে ইলিশ খেতে পারছে না।
জেলেরা ধারণা করছেন, কম বৃষ্টির পাশাপাশি অসংখ্য চর জেগে নদীর গভীরতা কমে যাওয়াও মেঘনায় ইলিশের বিচরণ কমার অন্যতম কারণ।
জেলে, স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে মেঘনা নদী ভ্রমণ করেও জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর ও ভোলা জেলার মাঝামাঝি মেঘনা নদীতে জাগছে অসংখ্য ভাসমান ও ডুবো চর। ডুবো চরের কারণে কমে গেছে নদীর গভীরতা।
তবে ইলিশ গবেষকরা বলছেন, মূলত বৃষ্টি না হওয়ার কারণেই নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়ছে। তাদের মতে, নদীতে ইলিশ কম পড়লেও সাগরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
লক্ষ্মীপুরের মেঘনাপাড়ের মতিরহাট ঘাটের ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান লিটন বলেন, 'ব্যবসা খুবই খারাপ। হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগ করে দৈনিক ১ হাজার টাকাও আয় থাকে না।'
লিটন বলেন, নদীতে এত বেশি চর আগে কখনও ছিল না। আবার গত কয়েক বছর যাবত প্রবল বৃষ্টির সময় জুন-জুলাই-আগষ্ট মাসে বৃষ্টি থাকে না। ভারী বৃষ্টিপাত না হলে নদীতে ইলিশ পাওয়া যায় না।
লক্ষ্মীপুরে গত বছর জুলাইয়ে ১৭৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও, এ বছর এই মাসে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৩১ মিলিমিটার।
রাসেল নামে আরেকজন মাছ ব্যবসায়ী বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় মেঘনার এ সীমানায় ইলিশ কমে গেছে। সঙ্গে অন্যান্য আরও অনেক প্রজাতির মাছ কমে গেছে।
রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার সেন্টার খাল ঘাটে জেলেনৌকার মাঝি তাফসির মুন্সী বলেন, 'মেঘনা নদীতে এ বছর মনে হয় ইলিশই নেই। বাধ্য হয়ে ছোট নৌকা নিয়েও ইলিশের জন্য জেলেদেরকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে সাগরে যেতে হচ্ছে।'
আলেকজান্ডার সেন্টার খাল ঘাটের পাশের খালপাড়ের সিকদার নামের আরেক জেলে জানান, গত শীত মৌসুমেও মেঘনায় কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ছিল না। নদীতে কম ইলিশের কারণে জেলেনৌকার জ্বালানি খরচও ওঠে না। যে অল্প কিছু ইলিশ পাওয়া যায়, সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করতে হয়।
জেলেরা বলেন, মৌসুমে ইলিশ ধরা না পড়ায় নদীপাড়ের বাজারগুলোতে লোক সমাগম কমে গেছে।
ইলিশ কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে মেঘনাপাড়ের স্থানীয় হাটবাজারে। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি, টাংকি বাজার, সেন্টার খাল ও মতিরহাট ঘাটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘাটেই ৫০০ গ্রামের নদীর ইলিশের দাম কেজি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা। আর কেজি সাইজের ইলিশের দাম ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা পর্যন্ত। তবে সাগরের ইলিশের দাম কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা কম।
স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ২-৩ বছর আগে রামগতি ঘাটে প্রতিদিন প্রায় ৫০ টন, আলেকজান্ডার ঘাটে ৪০ টন, টাংকি বাজার ঘাটে ৪০ টন এবং মতিরহাট ঘাটে প্রায় ২০ টন ইলিশ বিক্রি হতো। কিন্ত চলতি বছরে পুরো এক মাসেও এত ইলিশ বিক্রি হয়নি।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরে নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ৫০ হাজার ২৫২ জন। তাদের মধ্যে ৪০ হাজার রয়েছেন ইলিশজীবী। তবে ইলিশের সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীপাড়ের ১৩ পেশার প্রায় লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, গত ২ বছর যাবত নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলেদের জীবিকা নিয়ে ভবিষ্যতে সংশয় তৈরি হবে।
নদীতে ইলিশ কমে যাওয়ার বিষয়ে এ কর্মকতার অভিমত হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদীর চরের কারণে ইলিশ কমে গেছে। আবার কম বৃষ্টির কারণেও ইলিশ ধরা পড়ছে না।
কম বৃষ্টিপাতই মেঘনায় ইলিশ কম ধরা পড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলামও। তিনি বলেন, 'উপকূলে বৃষ্টি খুবই কমে গেছে। চাঁদপুরে জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ ৪১৭.৩ মিলিমিটার। কিন্ত চলতি বছরের জুলাইয়ে বৃষ্টি ছিল ১২২.২ মিলিমিটার।'
আমিরুল ইসলাম বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে যখন বৃষ্টিপাত বেশি হয়, পানির স্রোত বেড়ে যায়, তখন ইলিশের পরিমাণ বেশি হয়। এখন যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত শুরু হয়, তাহলে ইলিশ আসা শুরু করবে। তাছাড়া ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম অক্টোবর-নভেম্বর মাস সামনে রয়েছে, তখন হয়তো পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যেতে পারে।
নদীতে চর পড়ার কারণে ইলিশ কমে গেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি আমিরুল বলেন, 'নদীতে চর পড়া এবং নদীর গভীরতা কমে যাওয়া মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব। এর কারণেও ইলিশ কমে যেতে পারে। তবে সেটা নিয়ে আমাদের এখনও গবেষণা হয়নি।'
অন্যদিকে জুলাই মাস পর্যন্ত ইলিশ কম ধরা পড়ার কারণে সবাই যে বলছে ইলিশ নেই, সেটা মানতে নারাজ এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই ইলিশ ধরা শুরু হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জেলায় ২০ হাজার ৩৮০ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। দৈনিক গড় উৎপাদন ছিল প্রায় ৫৬ টন। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে উৎপাদিত হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টন। দৈনিক উৎপাদন ১০৪ টনের বেশি।