ইলিশের সরবরাহ বাড়লে— পাল্লা দিয়ে দাম কেন বাড়ে?
সামষ্টিক অর্থনীতির চাহিদা ও জোগানের সূত্র অনুসারে, পণ্যের দামের ওপর সেটির চাহিদা নির্ভর করে। অর্থাৎ, কোনো পণ্যের দাম বাড়লে – চাহিদা কমবে। আবার সরবরাহ বা জোগান বাড়লে, পণ্যটির চাহিদা যদি সে তুলনায় না বাড়ে – তাহলে কমবে দাম।
কিন্তু, দেশের ইলিশের বাজারে কাজ করছে না এই তত্ত্ব। অন্তত তেমনটাই দেখা যাচ্ছে।
হিসাব বলছে, গত ২৫ বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পাশাপাশি দামও কেজি প্রতি বেড়েছে ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা। এসময়ে জনসংখ্যা ও চাহিদা অবশ্য বেড়েছে, কিন্তু সেই হিসাব আমলে নিয়েও দেখা যাচ্ছে ইলিশের দাম কমেনি। উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ তবে কি?
অস্বাভাবিক এই ঘটনার কূলকিনারা খুঁজে পান না বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমানও।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে – বিগত দিনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা শেখানোর মত। বলা হতো গণতন্ত্র আছে, অথচ মানুষ ভোট দিতে পারতো না। তেমনি পণ্যের উৎপাদন ও জোগান বাড়লে – দামও বাড়বে এটা কোন মার্কেটিং পলিসিতে নেই। বিশ্বের আর কোন দেশে এমন বাজার ব্যবস্থা পাবেন না। শুধু বাংলাদেশেই অর্থনীতির সকল নীতি ভেঙে বাজার গড়ে উঠেছে। মূলত ইলিশের বাজার ঘিরে বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মূল্যস্ফীতিও ক্রেতাদের কাছে ট্রেন্ডিং হয়ে গেছে।
ইলিশ উৎপাদনের তথ্য
মৎস অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় জানিয়েছে, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে নদী ও সাগরের আহরণ মিলিয়ে দেশের ইলিশ উৎপাদন ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৫৩২ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ মেট্রিক টনে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গত বছরের রেকর্ড ভাঙবে বলে আশা করছে মৎস দপ্তর।
এদিকে উৎপাদন বাড়লেও পাল্লা দিয়ে বাজারে দামও বেড়েছে। গত সাত বছরে প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড়েছে দাম।
বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় চারটি মৎস অবতরণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। মৎস অবতরণ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে - বরিশাল জেলা মৎস অবতরণ কেন্দ্র পোর্ট রোড, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার উপজেলার আলীপুর মৎস অবতরণ কেন্দ্র, বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার বিএফডিসি মৎস অবতরণ কেন্দ্র এবং ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর পাইকারী বাজার।
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে এলসি [৬০০ থেকে ৮০০ গ্রাম] সাইজের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। ১২শ' গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হতো ১,১০০ টাকা, এবং আরও বড় দেড় কেজি ওজনের ইলিশের কেজি বিক্রি হতো ১,৫০০ টাকায়। ওই বছর জাটকা বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি দরে।
সেখান থেকে ২০২৪ সালে এসে এলসি সাইজের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১,৬৫০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১,৮০০ থেকে ১,৮৫০ টাকায়। ১২শ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১,৯৫০ টাকায়। দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২,২০০ থেকে ২,২৫০ টাকায়। এই বছর জাটকা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে।
নদী থেকে আড়ত
বরিশাল পোর্ট রোডের আড়ৎদার মাসুম সিকদার বলেন, 'বিভিন্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা ইলিশ কিনে বরিশালের বাজারে নিয়ে আসে। মাছের সরবরাহ যাই হোক জাটকা ও ইলিশের দাম বেশিই থাকছে। এর পেছনে প্রধানত দুটি কারণ উল্লেখ করেন মাসুম, প্রথমত খারাপ আবহাওয়ার কারণে সাগরে অনেক জেলে যেতে পারেননি, ফলে নদীর ইলিশ ও জাটকার সরবরাহ বেশি। দ্বিতীয়ত, রপ্তানির অনুমতি দেওয়ায় দাম আরো বেড়েছে। কারণ, বাজারে যা চাহিদা তার তিনভাগের এক ভাগও ইলিশের সরবরাহ নেই।'
বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবসায়ী আবু ইউসুফ বলেন, 'বিগত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশের সরবরাহ কম। সাগরে বৈরী আবহাওয়া থাকায় মাছ ধরার ট্রলার যেতে পারছে না। এজন্য শুধু নদীর মাছের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা চলছে। সাগরের মাছ আসলে দাম কমে যেত।'
ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচরের জেলে ইয়াসিন মোল্লা বলেন, দুই-তিন বছর আগেও ইলিশ পানির দরে বিক্রি করতে হয়েছে। এবার দাম ভালো হলেও সাগরে যেতে পারছি না। নদীতে যা পাচ্ছি তাতে ইঞ্জিন খরচ উঠছে না।
তথ্যের অসঙ্গতি নাকি ইলিশে আগ্রহ বেড়েছে মানুষের
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অপূর্ব রায় বলেন, 'ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সরকারি যে পরিসংখ্যান–- সে বিষয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। তারা কি এই পরিসংখ্যানের তথ্য বাজারে গিয়ে সঠিকভাবে পরিমাপ করে সংগ্রহ করেন কিনা, নাকি অনুমান-নির্ভর?'
'যদি উৎপাদন বাড়ে তাহলে অর্থনীতির সূত্র অনুসারে দামও তো কমে আসার কথা। কিন্তু, দাম কমছে না। এখানে আরেকটি ব্যাপার থাকতে পারে, জেলে থেকে ক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছতে যে মার্কেটিং চ্যানেল – সেখানে কোথাও ত্রুটি রয়েছে। কেউ যদি আড়তে অতিরিক্ত পরিমাণে মজুত করে থাকে – তাহলে ক্রেতা পর্যায়ে কৃত্রিম সংকট তৈরী হবে। তখন দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক' - যোগ করেন তিনি।
ড. অপূর্ব রায় মনে করেন, বাজার ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ না করলে, আর কারসাজি বন্ধ নাহলে — মূল্যের উলম্ফন কমানো যাবে না।
এদিকে বরিশাল জেলা মৎস কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলছেন ভিন্ন কথা, তার মতে, বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় উৎপাদন যেমন বেড়েছে– দামও তেমন বাড়ার কারণ ইলিশের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। তিনি বলেন, 'অতীতে যারা ইলিশ খেতো না তারাও এখন ইলিশ কিনছে। অর্থাৎ ক্রেতাও বেড়েছে বহুগুণে। ক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় দাম ও চাহিদা বেড়েছে। শুধু যে দেশের মানুষ খাচ্ছে, তা কিন্তু নয় আমাদের ১ কোটিরও বেশি প্রবাসীরা দেশ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে কিনে নিচ্ছে। বিদেশের শোরুমে আমাদের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আমাদের ইলিশের আর্ন্তজাতিক বাজার তৈরী হয়েছে। এই চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।'
যদিও বর্তমানে ইলিশের যে দর- তাতে করে এমনকী মধ্যবিত্তদেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ - এ বাস্তবতাটি এই কর্মকর্তার যুক্তিতে ধোপে টিকছে না।