চাহিদা ও কাঁচামালের দাম কমলেও রডের বাজার ঊর্ধ্বমুখী
আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে ইস্পাতের কাঁচামালের দাম কমেছে; তবে তা স্বত্বেও কমছে না ইস্পাত পণ্য এমএস রডের দাম। দীর্ঘদিন ধরে ঊর্ধ্বমুখী থাকা রডের বাজার এখনো লাখ টাকার ঘরে।
স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেট জাতীয় কাঁচামালের দাম গত তিন মাসে টনে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা কমেছে। তবে গত পাঁচ মাস ধরে উচ্চ গ্রেডের এমএস রড প্রতি টন ৯৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও শিপব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা।
দেশের শীর্ষ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেন গুপ্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এটা সত্য যে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কিছুটা কমেছে কিন্তু আমাদের স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব খুব কমই পড়বে, এর কারণ ডলারের উচ্চ বিনিময় হার। তাছাড়া, ডলার সংকটের কারণে ইমপোর্ট লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার ক্ষেত্রেও জটিলতা রয়েছে।"
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে ইস্পাত পণ্য এমএস রডের চাহিদা ও উৎপাদন কমে কমে গেছে।
চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারি রড ব্যবসায়ী মেসার্স জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এস এম কামরুজ্জামান বলেন, "রডের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে লোকজন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের অনেক প্রকল্পের নির্মাণকাজ এখন স্থবির। যেই কারণে রডের বেচাকেনা একদম কমে গেছে।"
রডের বাজারকে চাঙ্গা করতে হলে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্যটির দাম কমিয়ে আনতে হবে বলে মনে করছেন এই ব্যবসায়ী।
কাঁচামালের দাম কমেছে অনেকাংশেই
কে আর শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন বলেন, জুন মাস থেকে কমতে শুরু করে স্ক্র্যাপের দাম কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬০ হাজার টাকায়। মে মাসের শেষ দিকে এই স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৭০-৭১ হাজার টাকা। সেই হিসেবে, গেল দুই মাসে প্রতিটন স্ক্র্যাপের দাম কমেছে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা।
স্ক্র্যাপের পাশাপাশি কমে এসেছে ইস্পাতের কাঁচামাল প্লেট ও বিলেটের দামও। বর্তমানে বাজারে প্রতিটন প্লেট ৭৫ হাজার টাকা ও বিলেট ৭৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দুই মাস আগেও বাজারে প্রতিটন প্লেট ৮২ হাজার টাকা ও বিলেট ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।
সেই হিসেবে, দুই মাসের ব্যবধানে বাজারে প্রতিটন প্লেটে ৭ হাজার টাকা ও বিলেটে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমে গেছে।
এদিকে গত তিন-চার মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম টনে ৮০ ডলারের বেশি কমে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৫৪০ ডলারে। গেল মার্চ-মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৬২০ ডলারের বেশি।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন-চার মাস ধরে স্ক্র্যাপ ও পুরনো জাহাজের দাম কিছুটা কমেছে। তবে দিন দিন ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিকৃত জাহাজের বিপরীতে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।"
"এদিকে ইস্পাতের কারখানাগুলোতে কাঁচামালের চাহিদা কমে যাওয়ায় স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেটের দাম কমে গেছে। এতে লোকসানের ঝুঁকিতে রয়েছেন জাহাজভাঙ্গা শিল্পের ব্যবসায়ীরা," বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিক সময়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে ১৫-১৬ লাখ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ মজুদ থাকে। কিন্তু বর্তমানে স্ক্র্যাপের মজুদ ২-৩ লাখ টনের নিচে চলে এসেছে।
স্ক্র্যাপসহ সব কাঁচামালের দাম কমলেও এখনো আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে ইস্পাত খাতের প্রধান পণ্য এমএস রড।
ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে দফায় দফায় বাড়তে থাকে রডের বাজার। ২০২০ সালের অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া পণ্যটি আড়াই বছরে দফায় দফায় বেড়ে চলতি বছরের মার্চে লাখ টাকায় পৌঁছে।
এখনো কেন রডের দাম এত বেশি?
রড প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, ডলারের দাম বেশি থাকায় এবং বাজারে পণ্যটির চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তাই পণ্যটির দাম এখনও বেশি।
এমএস রড ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের (৫০০ টিএমটি) এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯৬ হাজার থেকে এক লাখ ৫০০ টাকায়।
৭৫ গ্রেডের রডের মধ্যে বর্তমানে বিএসআরএম এক লাখ ৫০০ টাকা, একেএস ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা, কেএসআরএম ও জিপিএইচ ৯৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত পাঁচ মাস ধরে প্রায় একই দামে বিক্রি হচ্ছে এসব ব্র্যান্ডের রড।
তবে গত এক মাসে টনে ৩-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দাম। বর্তমানে অটো মিলের ৬০ গ্রেডের এমএস রডের মধ্যে কেআর স্টিল ও এইচ এম স্টিল ৮৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া সেমি অটো কারখানার মধ্যে গোল্ডেন, এসএস, খলিল, আল ছাফা, চম্পা ও এসএল স্টিলের রড ৮৫-৮৬ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গত এক মাস আগেও বাজারে ৬০ গ্রেডের বিভিন্ন কোম্পানির এমএস রড ৯০ হাজার টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে।
কেএসআরএম স্টিলের জিএম (সেলস) মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে এসেছে তা ঠিক। কিন্তু দেশীয় বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য দিন দিন বাড়ছে। এখন আমাদের ১১৮-১১৯ টাকায় আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে।"
"এমনকি অতিরিক্ত দামের কারণে বাজারে রডের চাহিদা ও বিক্রি দুটিই কমে গেছে। এতে আমাদের উৎপাদন কমাতে হলেও খরচ কমাতে পারছি না। ফলে কাঁচামালের দাম কমার সেই সুফলটা পাচ্ছে না গ্রাহকরা," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) এর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রতিবছর ৭০-৭৫ লাখ টন এমএস রডের চাহিদা রয়েছে।
দেশের প্রায় ৫৫ টি অটো স্টিল রি-রোলিং মিলস ও শতাধিক সেমি অটো ও ম্যানুয়াল মিলস এসব রডের যোগান দিয়ে থাকে।