চট্টগ্রামে বন্যায় ১৩৫ কোটি টাকার ফসল, মাছ, গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি
চট্টগ্রামে বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে; আর এরইসঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। বন্যায় আউশ-আমনের ফলন, সবজির আবাদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে; যার পরিমাণ আনুমানিক ১৩৫ কোটি টাকা।
জেলায় এই তিন খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকায় উঠতে পারে বলে ধারণা করছে চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য অধিদপ্তর।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছচাষীরা। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে জেলার ১৩ হাজার ৩৭৯টি পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের।
এরমধ্যে ১৮৯ হেক্টর আয়তনের ১২৬টি মাছের ঘেরের সবকটি শতভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ৪ হাজার ১৫৪ মেট্রিকটন রুই, কাতল, মৃগেল, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস জাতীয় মাছ এবং ১৮৫ লাখ ৩৫ হাজার পোনা মাছ ভেসে গেছে।
জেলা মৎস্য অফিসের জরিপ কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জেলায় মাছ চাষ করা হয় এমন জলাশয় আছে ১৮ হাজারের বেশি। বন্যায় প্রায় ৭৪ শতাংশ পুকুর, দিঘি ও মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ফলে রুই জাতীয় মাছ চাষীদের প্রায় ৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া, পোনায় ৬৭০ লাখ ও চিংড়িতে ক্ষতি হয়েছে ৩৮০ লাখ টাকার। অবকাঠমোসহ সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৭৫ কোটি টাকার বেশি।"
তিনি আরও বলেন, "জুলাই-আগস্ট মাস হলো চাষীদের মাছ তোলার পিক টাইম। আগামী মাস থেকে পুকুরে নতুন করে পোনা ছাড়ার কথা। এ অবস্থায় বন্যা হওয়ায় মাছচাষী ও পোনাচাষী উভয়েই বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়েছেন। সন্দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪ উপজেলার মৎস্য খাত পুরোপুরি শূন্যে পৌঁছে গেছে।"
পাশাপাশি ১৫ জেলে আহত ও জেলেদের ৭৮টি মাছধরার নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান মো. মাহবুবুর রহমান।
সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে ৫,১০০ হেক্টর জমির সবজি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগর ও ১৫ উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ হাজার হেক্টর আমন ফসল, ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর আউশ ফসল, ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর আমনের বীজতলা এবং ৫ হাজার ১০০ হেক্টর সবজির আবাদ।
এরমধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরের পাঁচলাইশ, ডবলমুরিং ও পতেঙ্গা এলাকার ৫ হেক্টর জমির আউশ, ২০ হেক্টর জমির আমনের বীজতলা ও ১৪০ হেক্টর জমিতে লাগানো সবজির ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। বাদবাকি ক্ষতি হয়েছে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়াসহ ১৪ উপজেলায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কৃষি জমিগুলো থেকে এখনো বন্যার পানি নামেনি। ৫ হাজার ১০০ হেক্টর সবজির পুরোটাই একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে।"
"এছাড়া, আউশ ফসলের ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারন করেছে। চলতি মাসের শেষের দিকে এসব ফসল কাটার কথা ছিল। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামে কৃষির ক্ষতির পরিমাণ ৭০-৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে," বলেন তিনি।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সানমুন অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিসারিজের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বাবর জানান, বন্যায় সাতকানিয়া পুড়ানগর এলাকায় তার তিনটি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে প্রায় ৮ লাখ টাকার চিংড়ি। একই সঙ্গে, ২৮ একর জমির ধান ও সবজির আবাদ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
শহিদুল বলেন, "শরৎকালীন সবজি হিসেবে লাউ, বেগুন, বরবটি, চিচিঙ্গাসহ আট ধরনের সবজি আবাদ করেছিলাম। বন্যায় তা শতভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ, ধান ও সবজি মিলিয়ে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠবো বুঝতে পারছিনা।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, "চট্টগ্রামের সবজির ভাণ্ডার দোহাজারি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এবার চন্দনাইশে ১ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছিল।"
জীবন বাঁচাতে গবাদি পশুদের ছেড়ে দেন খামারিরা
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি টাকা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮৫টি গবাদি পশুর ও ২৬৫টি হাঁস-মুরগির খামার।
এছাড়া, নষ্ট হয়েছে ৯৩ মেট্রিকটন দানাদার খাবার, ৬৭ মেট্রিকটন শুকনো খড় এবং ২৬২ মেট্রিকটন ঘাস। এতে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, "আকস্মিকভাবে বন্যা হওয়ায় খামারিরা একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকে গরু-ছাগল উঁচু জায়গায় নিয়ে যেতে না পেরে ছেড়ে দিয়েছেন। হাঁস-মুরগি সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তেমন ছিল না, তাই ক্ষতি বেশি হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আমরা এখন পর্যন্ত শুধু খামার গুলোর ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়েছি। এর বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকে গবাদি পশু লালন-পালন করেন, সেসব ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে আমরা এখনও জানিয়া।"
বন্যায় এই তিন খাতের বাইরে সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও স্থাপনার ব্যপক ক্ষতি হলেও সে সবের বিবরণও এখনো পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় বন্যায় প্রাথমিকভাবে ১৩৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছে। তবে এটিকে একেবারে প্রাথমিক ধারণা বলছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারছি না। ১৩৫ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটি একেবারে প্রাথমিকভাবে করা হয়েছে।"
"বন্যার পানি কমে গেলে বিভিন্ন সংস্থা রিপোর্ট দেবে, যার জন্য অন্তত একমাস সময়ের প্রয়োজন। পরিস্থিতি দেখে আশঙ্কা করছি প্রকৃতক্ষতির পরিমাণ আমাদের অনুমানকে ছাড়িয়ে যাবে," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রামে চলতি আগস্ট মাসের গত ৭ দিনে ৬৬৪ মিলিমিটার (মিমি) বৃষ্টিপাত হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ১৪টি উপজেলা এবং নগরের ৬ লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন লোক বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন; মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন।