ঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে বায়ু দূষণে আয়ু কমছে বাংলাদেশিদের: গবেষণা
বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই)। এছাড়া, রাজধানী ঢাকা ছাড়াও চারটি নতুন ঘনবসতিপূর্ণ জেলাকে বায়ু দূষণজনিত কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে তারা।
মঙ্গলবার প্রকাশিত সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স অনুসারে, শিল্প কারখানা বেশি থাকা গাজীপুর জেলার বাতাসে ৮৯.৮ দূষণকারী কণা রয়েছে (পিএম ২.৫), যা পুরো দেশের বাতাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এরপরই রয়েছে নোয়াখালী। ৮৮.৭ পিএম ২.৫ কণা রয়েছে এখানকার বায়ুতে। ঢাকার বায়ুতে ৮৭.২ পিএম ২.৫; কুমিল্লার বায়ুতে ৮৮.২ পিএম ২.৫; এবং টাঙ্গাইলের বায়ুতে ৮১ পিএম ২.৫ দূষণকারী কণা রয়েছে।
এর আগের সূচকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ ছিল শীর্ষ পাঁচ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা।
একিউএলআই জানিয়েছে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণকারী কণা নিয়ন্ত্রণে থাকলে বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশনা অনুযায়ী পিএম ২.৫ এর ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম এর মধ্যে থাকলে, গাজীপুর, নোয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লা এবং টাঙ্গাইলের বাসিন্দাদের আয়ু বাড়তো আরো ৮ বছর।
আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে কণার দূষণ বাংলাদেশে মানব স্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি (এর সাথে আরো রয়েছে হৃদরোগ সংক্রান্ত নানা রোগ)। একিউএলআই অনুযায়ী, এ দূষণজনিত কারণে গড়ে একজন বাংলাদেশির আয়ু কমে ৬.৮ বছর।
অথচ, ক্ষতিকর তামাক ব্যবহারেও মানুষের গড় আয়ু এত কমেনা। তামাক ব্যবহারে গড় আয়ু কমে ২.১ বছর। এছাড়া, শিশু ও মাতৃ অপুষ্টি গড় আয়ু কমায় ১.৪ বছর।
পিএম ২.৫ হলো ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তারচেয়ে কম ব্যাসের সূক্ষ্ম কণা। দূষণকারী অন্যান্য কণার মধ্যে এ কণা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক কারণ এটি ফুসফুসের বাধা ভেদ করতে পারে এবং রক্তের প্রবাহে প্রবেশ করতে পারে। যা থেকে পরে কার্ডিওভাসকুলার এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ এমনকি ক্যান্সারও হয়।
২০২০ সালের মাত্রার তুলনায় কণা দূষণ ২.১% কমলেও, বাংলাদেশে কণার দূষণ গত এক দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকার তুলনায় প্রায় ১৪ থেকে ১৫ গুণ বেশি হয়েছে।
বায়ু দূষণ গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর আবদুস সালাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে সিলেট ছাড়া পুরো বাংলাদেশই দূষিত বাতাসে ঢেকে যায়।
"এর অভ্যন্তরীণ উৎসগুলো হলো ইট ভাটা, চালের কল এবং রাস্তায় চলাচলের জন্য অযোগ্য পরিবহন; যার সবই নিম্নমানের জ্বালানীতে চলে। এছাড়াও, শীতকালীন বাতাসের সাথে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্তীয় কণার দূষণও বাংলাদেশের বায়ুর গুণমানকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে," অধ্যাপক সালাম বলেন।
হু বায়ু দূষণকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য একক বৃহত্তম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতি বছর, বায়ু দূষণের সংস্পর্শে এসে বিশব্যাপী ৭ মিলিয়ন মানুষের অকাল মৃত্যু হয় বলে অনুমান করা হয়।
প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসযন্ত্রের রোগ হয় সবচেয়ে বেশি, ফলে হাঁপানি রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগেন।
ডা. লেলিন আরো বলেন, তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে নতুন যক্ষ্মা এবং হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বাড়ে। সেইসাথে বাড়ে শ্বাসযন্ত্রের অ্যালার্জি, হাঁচি এবং কাশির মতো সমস্যা।
দূষণের কারণে শ্বাসযন্ত্রের পাশাপাশি কিডনি ও লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ু দূষণ ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী," লেলিন বলেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর চার মাস।
তবে ডা. লেলিন এর মতে, বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়লেও এটি আদর্শ নয়।
"দূষণের কারণে বিভিন্ন রোগ আমাদের জীবনযাত্রার মান নষ্ট করছে," বলেন তিনি।
যদিও বাংলাদেশে বায়ু দূষণজনিত মৃত্যুর কোনো সরকারি রেকর্ড নেই, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজিজেস অফ দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটাল ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরী বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগীর চিকিৎসা করেছে। সাত বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ৮৫ হাজার।
অন্যান্য দূষণকারীর তুলনায় বায়ু দূষণ অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করে। বায়ু দূষণের মাত্রা হ্রাস কমিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোগবালাই এর বোঝা কমাতে পারে। একইসাথে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী অসুস্থতাও কমাতে পারে বলে জানিয়েছে একিউএলআই।
বাংলাদেশের ১৬৪.৮ মিলিয়ন মানুষের সবাই এমনসব এলাকায় বসবাস করে যেখানে বার্ষিক গড় কণা দূষণের মাত্রা হু নির্দেশিকা এবং দেশের নিজস্ব জাতীয় মান (প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম) উভয়কেই ছাড়িয়ে যায়। এমনকি সবচেয়ে কম দূষিত জেলা সিলেটেও কণার দূষণ হু পিএম ২.৫ নির্দেশিকা থেকে ৯.৭ গুণ বেশি এবং জাতীয় মানদণ্ডের চেয়ে ৩.২ গুণ বেশি।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২২.৯% এর বাস। অথচ এ চারটি দেশই বিশ্বের শীর্ষ দূষিত দেশ।
২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে কণার দূষণ ১২.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারতে ৯.৫% এবং পাকিস্তানে ৮.৮% বেড়েছে।
এদিকে, চীন ২০১৪ সালে 'দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করার পর থেকে দূষণ কমাতে বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে দূষণ কমেছে ৪২.৩%, এবং তাদের জনসংখ্যার গড় আয়ু বেড়েছে ২.২ বছর।
বায়ু দূষণ গবেষক অধ্যাপক সালাম বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে চীনের একাধিক পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন।
"চীন তাদের প্রায় সবগুলো কয়লাচালিত শিল্প বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া, চীনের কঠোর ট্রাফিক নিয়মের কারণে নোংরা জ্বালানী এবং অযোগ্য পরিবহন ব্যবহার কমেছে। আমরা যদি বাংলাদেশের সাথে চীনের এসব পদক্ষেপের তুলনা করি, তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো কেন বাংলাদেশ বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে," বলেন তিনি।