ঢাকার বাইরে উদ্বেগজনক মাত্রায় এডিসের উপস্থিতি, বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সমীক্ষা অনুসারে, এ বছর দেশব্যাপী গ্রামীণ এলাকায় এডিস মশার প্রকোপ বেড়েছে তীব্রহারে। গত কয়েক মাস ধরে গ্রামে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
জরিপে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুর সংক্রমণের জন্য দায়ী ডমিনেন্ট স্ট্রেইন হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস।
ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য দায়ী ভেক্টর এডিস মশা। এ প্রজাতির মশার দুটি প্রধান স্ট্রেইন- এডিস অ্যাজিপটি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস।
এডিস অ্যাজিপটি মূলত শহরাঞ্চলে বেশি, আর গ্রামাঞ্চলে বেশি এডিস অ্যালবোপিকটাস। এসব মশা গাছের গুঁড়ি, কলাগাছের বাকল এমনকি পাতায় জল জমে থাকা পানিসহ বিভিন্ন জায়গায় ডিম পাড়ে।
কীটতত্ত্ববিদদের মতে, এডিস এজিপটির তুলনায় এডিস অ্যালবোপিকটাস নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি জটিল। এই জটিলতার কারণে গ্রামীণ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
এডিস অ্যালবোপিকটাস সাধারণত প্রাকৃতিক জলাধারে বেড়ে ওঠে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ
১১ জুলাই পিরোজপুরের নেশারাবাদের বলদিয়া ইউনিয়নে ১০টি গৃহস্থালীর ওপর একটি জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরমধ্যে সাতটি বাড়িতেই এডিস লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব গৃহস্থালীর ১৬টি কন্টেইনার পরিদর্শন করে আটটিতেই এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।
এরপর ২৩ জুলাই পটুয়াখালীর দুমকির আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রামের ১০টি বাড়ির মধ্যে সাতটিতে এডিস মশার লার্ভা ধরা পড়ে। এই বাড়িগুলোতে পরিদর্শন চালানো ৩৭টি কন্টেইনারের মধ্যে ১০টিতে এডিসের লার্ভা শনাক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও যশোর পৌরসভা এলাকায় ২০টির মধ্যে ১১টি গৃহস্থালীতে এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৌরসভার গড় ব্রুটো ইনডেক্স (এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক) ছিল ৮০।
প্রতি ১০০ বাড়িতে পরিদর্শন করা লার্ভা কন্টেইনারের সংখ্যা নির্দেশ করে ব্রুটো ইনডেক্স। স্বাভাবিক অবস্থায়, একটি এলাকার সূচক ২০ এর নিচে হওয়া উচিত।
এদিকে, ৫ থেকে ৯ জুলাই রাজশাহী শহরের পাঁচটি ওয়ার্ডের ৭৫টি গৃহস্থালীর উপর পরিচালিত একটি সমীক্ষায় ৩৭.৩% বাড়িতে এডিস লার্ভা পাওয়া গেছে। রাজশাহী শহরের গড় ব্রুটো ইনডেক্স ৪৬.৬৭।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২০% এডিস এজিপটি ৮০% এডিস অ্যালবোপিকটাস আছে বলে জানা গেছে জরিপে।
২৩ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টি তে একটি বিস্তৃত জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এই ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৪টিতে ব্রুটো সূচক ২০ ছাড়িয়েছে।
গাজীপুরে ২৩.৬% এডিস এজিপটি এবং ৭৬.৪% এডিস অ্যালবোপিকটাসের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গেছে।
৩০ জুলাই থেকে ৩ আগস্টের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের ৭০৫টি গৃহস্থালীতে জরিপ চালানো হয়। এগুলোর মধ্যে ৯৫টিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উপর বেশি জোর দিতে হবে। গ্রামগুলোতেও স্প্রে করার প্রচারণা প্রসারিত করতে হবে। পরিষ্কার পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়ে মানুষের সচেতনতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
এ কীটতত্ত্ববিদ আরও বলেন, এ বছর শীত শুরু হওয়ার পর ডেঙ্গুর পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
এদিকে, নোয়াখালী পল্লী উন্নয়ন সোসাইটির (এনআরডিএস) নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক জাতীয় উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
"ম্যালেরিয়া নির্মূলে সরকারের অতীত প্রচেষ্টার মতোই ডেঙ্গু মোকাবেলার জন্য একটি অনুরূপ দেশব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। জাতীয় প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে এতে সম্পৃক্ত করা অত্যাবশ্যক," বলেন তিনি।
তিনি পরামর্শ দেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করার জন্য ব্যাপক টিকাদানসহ একটি সক্রিয় পদ্ধতি বিবেচনা করা উচিত।
ইন্দোনেশিয়ার মতো অন্যান্য দেশ, যারা ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেয়, তাদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন আনার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
২৪ ঘণ্টায় ১৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু
বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ১৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং ২,৩০৮ জন নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে এ বছর ৫৩৯ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে; হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০৮ জন।
নতুন আক্রান্তের মধ্যে ৮৭৫ জন ঢাকার, এবং ১,৪৩৩ জন দেশের বিভিন্ন স্থানের।
ডিজিএইচএসের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ৩,৮১৭ জনসহ মোট ৮,৩৭৮ জন ডেঙ্গু রোগী এখন সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।