গ্যাস সংকট: নবনির্মিত ঘোড়াশাল কারখানা চালু করতে বন্ধ যমুনা সার কারখানা
দেশে চলমান গ্যাসের সংকটের কারণে দুই সার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে আগেই, নতুন করে এই তালিকায় যোগ হলো জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় দেশের বৃহত্তম ইউরিয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল)।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে চারটি সার কারখানার মধ্যে একটি যমুনা সার কারখানা; মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) অনির্দিষ্টকালের জন্য এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিসিআইসি কর্মকর্তাদের মতে, নবনির্মিত ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে সরবরাহ বাড়াতে সরকার যমুনা সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে নবনির্মিত ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজারে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে; এ বছরের শেষ নাগাদ কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্থানীয়ভাবে ইউরিয়ার উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানি নির্ভরতা ও খরচ কমানোর লক্ষ্যে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ঘোড়াশাল সার কারখানা।
ঘোড়াশাল কারখানার বার্ষিক সার উৎপাদন ক্ষমতা ১০ লাখ টন। যদিও দেশে চাহিদার পরিমাণ ২৬ লাখ টন।
তবে নতুন এই কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে পুরনো কারখানাগুলো গ্যাস সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে, যা সরকারের আমদানি নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
এদিকে, বিসিআইসি'র অধীনে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (এসএফসিএল), যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (এএফসিসিএল)- এই ৪ কারখানা থেকে চলতি বছরে ১০ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বরে সিইউএফএল, চলতি বছরের এপ্রিলে এএফসিসিএল এবং এখন জেএফসিএল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিসিআইসি'র পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) মো. শাহীন কামাল টিবিএসকে বলেন, "সক্ষমতা বিবেচনায় আমরা পেট্রোবাংলাকে বলেছিলাম অন্তত দুটি কারখানা চালু রাখতে। কিন্তু পেট্রোবাংলা ঘোড়াশাল পলাশ-এর পাশাপাশি শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (এসএফসিএল) গ্যাস সরবরাহের কথা জানিয়েছে। যে কারণে জেএফসিএল বন্ধ করতে হলো। কবে গ্যাসের সরবরাহ ঠিক হবে, তা কেউই বলতে পারছে না।"
বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, জেএফসিএল থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে, সবশেষ দুই মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১,২৫০ মেট্রিক টন করে মোট ৬৫,৯৭৭ মেট্রিক টন সার উৎপাদিত হয়েছে এই কারখানায়।
গ্যাস বিতরণের কৌশল
পেট্রোবাংলা দেশের সার কারখানাগুলোতে গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন ২৫০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন কিউবিক ঘনফুট) গ্যাস সরবরাহ করেছে। তবে ২০২২ সালের জুনের পর থেকে গ্যাসের বরাদ্দ কমিয়ে ১৩০ এমএমসিএফ করা হয়। অথচ বিসিআইসি'র চারটি কারখানা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালু রাখতে হলে কমপক্ষে ১৮৯ এমএমসিএফ গ্যাস প্রয়োজন।
পেট্রোবাংলার সরবরাহ করা ১৩০ এমএমসিএফ থেকে জেএফসিএল প্রতিদিন ৪১-৪২ এমএমসিএফ ব্যবহার করছিল।
তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন ডিভিশন) ইঞ্জিনিয়ার মো. সেলিম মিয়া বলেন, "ঘোড়াশাল সার কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ৭২ এমএমসিএফ গ্যাসের প্রয়োজন হচ্ছে। ঘোড়াশালে এই পরিমাণ সরবরাহ করার জন্য আমাদের অন্যান্য কারখানায় সরবরাহ কমাতে হয়েছে।"
"সরকারের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে জেএফসিএল কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘোড়াশাল কারখানা চালু হতে চলেছে, তাই সরকার আমাদেরকে পুরোদমে গ্যাস সরবরাহ করতে বলেছে," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) সংশ্লিষ্টদের নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি সভাও করেছে। এই সভায় শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির চাওয়া ছিল, সক্ষমতার বিবেচনায় জেএফসিএলকে চালু রাখা। কিন্তু শাহজালালের অবস্থান সিলেটের গ্যাসক্ষেত্রের কাছাকাছি হওয়ায় তারা সেখানে গ্যাস সরবরাহ চালু রাখার কথা জানায়। জেএফসিএল এর অবস্থান অনেক দূরে হওয়ার কারণে তারা এখানে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ঘোড়াশালে গ্যাস সরবরাহের সিদ্ধান্ত দেয়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জানান, "বর্তমানে সার উৎপাদনে (কাফকোসহ) দৈনিক ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ রয়েছে। যমুনা ও শাহজালাল সার কারখানা দুটোতে দৈনিক ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এরচেয়ে কম গ্যাস দিয়ে নতুন সার কারখানায় ২০ শতাংশ সার বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হবে।"
তিনি বলেন, "ভবিষ্যতে গ্যাসের সংস্থান হলে যমুনা ও শাহজালাল সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হবে।"
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন পেট্রোবাংলার ২,৩০০-২,৪০০ এমএমসিএফ গ্যাসের উৎপাদন ছিল, তখন সার কারখানাগুলোর বরাদ্দ ছিল ২৫০ এমএমসিএফ; এখন এলএনজিসহ প্রায় ৩,০০০ এমএমসিএফ গ্যাসের সক্ষমতা থাকলেও সার কারখানার সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।
স্থানীয় কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রভাব
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত বিসিআইসির আওতাধীন সবচেয়ে বড় কারখানা হলো জেএফসিএল। কারখানাটি থেকে উত্তরাঞ্চলের ২১টি জেলায় নিয়মিত সার সরবরাহ করা হতো।
এখন থেকে এসব জেলায় অন্যান্য কারখানা থেকে সার সরবরাহ করা হবে, যার জন্য লাগবে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ। আর তিনটি কারখানা দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ থাকলে তা দেশের কৃষি উৎপাদনেও প্রভাব ফেলবে।
বর্তমানে সারাদেশে আমন মৌসুমের ধান চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২ লাখ টন ইউরিয়া প্রয়োজন। বিসিআইসি'র কাছে বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৬ লাখ ৬৩ হাজার টন। একই সঙ্গে আমদানির প্রক্রিয়াও চলছে।
এদিকে, আমনের মৌসুমে সার নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসি সূত্র। তবে চলতি বছরের মধ্যে ঘোড়াশাল কারখানা চালু না হলে আগামী বোরো মৌসুমে বড় ধরনের সংকট দেখা দেবে।
তাছাড়া, এসব কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জেএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, এক কেজি ইউরিয়া সার উৎপাদনে কারখানার খরচ হতো ২২.৮৪ টাকা। আর বর্তমানে বিসিআইসি ইউরিয়া আমদানিতে প্রতিকেজি ৭০ টাকা করে খরচ করছে, যা স্থানীয় কারখানার উৎপাদন খরচের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
সম্প্রতি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান।
ওই চিঠিতে বিসিআইসির চেয়ারম্যান বলেছেন, "গ্যাসের সরবরাহ বাড়িয়ে অন্তত তিনটি কারখানা চালু রাখা গেলেও বছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে স্থানীয় উৎপাদন নিশ্চিত ও সরবরাহ ঠিক রাখতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো জরুরি।"
এছাড়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের কারণে জেএফসিএলও বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
জেএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল্লাহ খান টিবিএসকে বলেন, "কারখানা বন্ধ থাকলে প্রতিমাসে বেতন ভাতা এবং পরিচালন ব্যয় বাবদ অন্তত ১৩ কোটি টাকা খরচ হবে। কারখানাটি পুরানত হলে এখনও বিসিআইসির ৪টির মধ্যে এর সবচেয়ে বেশি সার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। স্থানীয় উৎপাদন থেকে সার সরবরাহ আসলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপরেও চাপ কমতো।"