ছাইয়ের মধ্যেও স্বপ্ন খুঁজছেন কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা, সরকারি সহায়তার দাবি
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে রিয়াদ জুয়েলার্সের আমির হোসেন প্রায় ২৩ বছর ধরে স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসা করে আসছিলেন। বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে এসেও নিজের দোকান বাঁচাতে পারেনি তিনি। চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হতে দেখেছেন প্রায় ৩ কোটি টাকার স্বর্ণালাঙ্কারসহ তার দুই দোকান।
শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দেখা যায়, দুই ছেলে ও দোকানের কর্মচারীসহ পুড়ে যাওয়া গহনার ছাই খুঁজছেন আমির হোসেন। পুড়ে সব ছাই হলেও আমির হোসেনের আশা 'যদি কিছু বেঁচে যাওয়া স্বর্ণ পাওয়া যায়'!
আমির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জীবনের সকল আয় এবং পরিশ্রম দিয়েছিলাম আমার দুটি দোকানে। এই দোকান দুটির আয়ের ওপরেই সংসার চলতো। দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাতাম। এখন আমার আর কোনো সম্বল থাকলো না।"
শুধু আমির হোসেনই নয় মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে পুড়ে যাওয়া স্থায়ী ২৪৩টি দোকানসহ প্রায় চার শতাধিক দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা শুক্রবার ধ্বংসস্তুপ থেকে কোনো বেঁচে যাওয়া পণ্য কিংবা টাকা পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজছিলেন।
ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতি বলছে, এ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মার্কেটে মুদি, স্টেশনারি, কনফেকশনারি, জুয়েলার্স, প্লাস্টিকের সামগ্রী, চাল, মসলা, ক্রোকারিজ, কাপড়, জুতার দোকান ছিল। প্লাস্টিকের দোকানে আগুন লাগায় তা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে তারা কেউই ভেতরে ঢুকতে পারেননি।
দোকানগুলোর মধ্যে প্রায় ৩৫টি স্বর্ণের দোকান ছিল। প্রতিটি স্বর্ণের দোকানে দেড় থেকে তিন কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কারের মালামাল ছিল বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেন তাদের এই মার্কেটটি আগের মতো করে তৈরি করে দেয় সিটি কর্পোরেশন।
ভাই ভাই কসমেটিকস এবং কসমেটিকস জোন– এই দুই দোকানের মালিক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম শুক্রবার দুপুরে দোকানের ভিতরের পোড়া ছাইয়ের মধ্য থেকে তার টাকার বাক্সটি বের করে পোড়া টাকা নিয়ে কাঁদছিলেন। বার বার বলছিল, "আমার সব স্বপ্নগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেল।"
জহিরুল জানান, তার একটি দোকানেই প্রায় ১ কোটি টাকার মালামাল ছিল।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "অগ্নিঝুঁকির কোনো নোটিশই আমাদের দেওয়া হয়নি। ঝুঁকির কোনো কারণও ছিল না। গত দুই বছর আগেও নতুন করে এই মার্কেটে টিন লাগিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। তখনও কিছু বলেনি।"
যত দ্রুত সম্ভব মার্কেটটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সিটি কর্পোরেশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং বহুতল মার্কেট তৈরির কথা বলে কালক্ষেপণ না করে তাদেরকে দ্রুত বসার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আগের মতো টিনশেড একতলা মার্কেটই চান ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের তালিকা করা হচ্ছে। শুক্রবার সকালে তালিকাভুক্ত কর্মচারীদের চাল, ডাল, তেল দিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে সহযোগীতা করা হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা চাই, অন্য কোনো মার্কেটে যাতে আর আগুন লাগার ঘটনা না ঘটে প্রশাসন দ্রুত সে ব্যবস্থা করুক।"
"ব্যবসায়ীদের টিনশেড মার্কেট তৈরি করে বসার সুযোগ করে দেওয়া হোক। সারাবিশ্বে এভাবে টিনশেড মার্কেটের প্রচলন আছে। প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন চাইলে এক মাসের মধ্যে টিনশেডের মার্কেট তৈরি করে দিতে পারবে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, কেন মাঝরাতে বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগে তার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ফজলুল হক প্রায় ২৬ বছর ধরে এই মার্কেটে ব্যবসা করে আসছেন। একটি কাপড়ের দোকান দিয়ে শুরু করেছিলেন ব্যবসা, এখন তিনি পাঁচটি দোকানের মালিক।
ফজলুল বলেন, "আমার পাঁচটি দোকানে প্রায় দেড় কোটি টাকার মালামাল ছিল। কিছুই বাঁচাতে পারিনি।"
তিনি বলেন, বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষ ও বাজার কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের নাম তালিকাভুক্ত করছে, কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
স্টেশনারি সামগ্রী ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়াও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় রয়েছেন। তিনি বলেন, "বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দ্রুত সহায়তা ও পুনর্বাসন প্রয়োজন।"
এদিকে, শুক্রবার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট পরিদর্শন করেন কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক।
এ সময় তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা যাতে নিয়ম-কানুন মেনে ব্যাংক ঋণ নিতে পারে সে ব্যবস্থাও করা হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহমান জানান, তারা আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন।
তিনি বলেন, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ৫৪৪ জন বিক্রয়কর্মীর পাশাপাশি ২৬৮ জন মালিক ও ব্যবসায়ীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সালু বলেন, তারা অস্থায়ী ব্যবস্থা নিয়ে সেখানে ব্যবসা শুরু করার অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করবেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে সজল জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।