নদীতে হাহাকার, চাহিদা মেটাচ্ছে সাগরের ইলিশ
খুলনার নদীগুলোতে একসময়ে প্রচুর ইলিশ মিলত। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে এখন আর ইলিশ মিলছে না।
জেলেদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর খুলনাঞ্চলের নদীগুলোতে ইলিশ মিললেও, এই বছর একেবারে নদীতে কোন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি মৌসুমের শুরুতে খুলনার কাজিবাছা নদীতে ইলিশ ধরার জন্য দেড় লাখ টাকা খরচ করে জাল তৈরী করেছিলেন প্রদীপ মন্ডল।
তিনি জানান, গত ১০ দিন ধরে নদীতে জাল দিয়ে একটি মাছও পাননি। এর আগের বছর এই সময়ে প্রতিদিন ২ থেকে ১০টি করে মাছ পেয়েছিলেন।
প্রদীপ মন্ডল জানান, "একদিন নদীতে জাল ফেলতে গেলে কমপক্ষে ৩ জন জেলেকে পরিশ্রম করতে হয়। ৫০০ টাকার তেল কিনতে হয়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। তারপর যখন মোটেই মাছ পাওয়া যায় না, তখন দুঃখের শেষ থাকে না।"
কাজীবাছা নদীর উজানের অংশের নাম রূপসা ও ভাটার অংশের নাম পশুর। পশুর নদীটি সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে শিবসা নদীর সাথে মিলিত হয়ে কুঙ্গা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে।
জেলেরা জানিয়েছেন, সুন্দরবনের মধ্যে পশুর ও শিবসাতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়তো। তবে গত ৫ বছর ধরে সেখানেও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
কারণ হিসেবে জেলেরা জানিয়েছেন, কুঙ্গা নদী যেখান থেকে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে, সেখানে বেশ চর জেগে উঠেছে। ফলে আগের মত খরস্রোত আর নেই। যার কারণে ইলিশ নদীতে প্রবেশ করছে না।
কুঙ্গা নদীর এক পাড়ে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের দুবলার চর ও ডিমের চর এলাকা ও অন্যপাড়ে পশ্চিম বন বিভাগে নীল কমল অভয়ারণ্য কেন্দ্র অবস্থিত।
নীল কমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, কুঙ্গা নদীর মরজাত এলাকায় বিশাল বড় চর জেগে উঠেছে। যার কারণে সেখানে নদীর প্রস্থ ও গভীরতা কমে গেছে। তাই সাগর থেকে ইলিশ এখন আর নদীতে তেমন যাচ্ছে না।
তবে খুলনাঞ্চল সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে প্রচুর ইলিশ মিলছে। বর্তমানে জেলেরা দুবলার চরে অবস্থান করে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ আহরণ করছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
দুবলা জেলে পল্লী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে এখন প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। জেলেরা দুবলার চরে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে অবস্থান করে সাগর থেকে মাছ আহরণ করছে।
সেখানে গিয়ে জেলেদের সাথে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তারা জানিয়েছেন, দুবলার চর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে বঙ্গোপসাগেরের সব থেকে গভীর স্থান সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। তবে সাগরের দুবলা সৈকত থেকে ২০ কিলোমিটারের দূরত্বে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে।
আসাদুল ইসলাম একজন সামুদ্রিক মাছ শিকারী। যিনি একটি ফিশিং বোটে ২০ জন জেলেকে নেতৃত্ব দিয়ে গভীর সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করেন।
তিনি বলেন, "কুঙ্গা ও বঙ্গোপসাগর যেখানে মিলিত হয়েছে, গত ১০ বছর আগে আমরা সেখানে বেশি ইলিশ পেতাম। তবে ওই মোহনায় এখন আগের মত আর স্রোত নেই। তাই সেখানে ইলিশ মেলে না। এখন ইলিশের একমাত্র ভরসা বঙ্গোপসাগর।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের দেশের বড় বড় নদীগুলো প্রতিনিয়ত নাব্যতা হারাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে ইলিশের একমাত্র উৎস হবে বঙ্গোপসাগর। যেটা আমরা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা থেকে থেকে আগেভাগে প্রমাণ পাচ্ছি।"
সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর থেকে যেসব ইলিশ মাছ ধরা হয়, তার বেশিরভাগই বিক্রির জন্য তোলা হয় খুলনার রূপসা ঘাট ও ৭ নং ঘাটের পাইকারি মাছ বাজারে। সেখান থেকে সারাদেশে বিক্রির জন্য সামুদ্রিক মাছ কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
রূপসা ঘাট পাইকারি মাছ বাজারের ব্যবসায়ী আনোয়ার বলেন, সাগরের ইলিশ পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিপোতে আসছে। তবে নদীর ইলিশ এখন এই বাজারে আসে না। যদি কোন জেলে নদীতে সামান্য ইলিশ পান, তবে গ্রামের বাজারেই বিক্রি করেন।
খুলনা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছর আগেও খুলনা জেলায় ৭ হাজার জন ইলিশশিকারি জেলে ছিলেন। বর্তমানে মাত্র ২ হাজার জন এ পেশায় টিকে আছেন। এর মূল কারণ হলো, নদীতে ইলিশ না পাওয়া।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খুলনাঞ্চলের অধিকাংশ নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ইলিশ মূলত সাগরে থাকে। নদীর খরস্রোত স্থানে ডিম ছেড়ে দেওয়ার জন্য মোহনা দিয়ে প্রবেশ করে। তাই যেসব নদীতে খরস্রোত নেই, সেখানে ইলিশ পাওয়া যাবে না। তবে আমাদের উপকূল সংলগ্ন সাগর থেকে প্রতিবছরই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে।"
তিনি বলেন, "খুলনা জেলার অনেক ইলিশশিকারি জেলে এখন বেকার হয়েছেন। তাই তাদের আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানে যুক্ত করার চেষ্টা করছি।"