একটা কাগজ যেন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল: এগারসিন্দুর দুর্ঘটনা বর্ণনা করলেন ডাক্তারযাত্রী
'একটা কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলে যেমনটা দেখায়, আমাদের পেছনের দুটি বগির অবস্থা হয় অনেকটা সেরকম। মালবাহী ট্রেন ধাক্কা দেওয়ার পর সেগুলোকে আর বগি বলে চেনার উপায় ছিল না' — ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনার ভয়াল বর্ণনা এভাবেই দেন কিশোরগঞ্জের জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ইয়াশফিনুল হক মুনিম।
আজ সোমবার (২৩ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে আন্তঃনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেসে একটি মালবাহী ট্রেন ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে এপর্যন্ত ১৭ জন নিহত হওয়ার কথা জানা গেছে। আহত হয়েছেন প্রায় একশ যাত্রী। নিহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মুনিম ছিলেন এগারোসিন্ধু এক্সপ্রেসের 'খ' বগিতে, যেটা ছিল মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বগিদুটোর একবারে সামনের বগি।
মুনিম বলেন, 'আমাদের ট্রেন আসতে ৩০ মিনিট দেরি করে। তারপর স্টেশন ছাড়তে শুরু করলে যখন স্পিড বাড়ানোর পর্যায়ে ছিল–এরমধ্যেই হঠাৎ করে উল্টো ট্রেনের গতি কমতে শুরু করলো। যেন কেউ শেকল দিয়ে দিয়ে আমাদের ট্রেনের গতি আটকে দিচ্ছে, থামতে বাধ্য করছে।'
পুরো ট্রেন তখন কেঁপে ওঠে, আর তারপরেই প্রচণ্ড এক শব্দ শোনেন মুনিম।
'ট্রেন থামা মাত্রই আমরা নিজেদের বগি থেকে নেমে আসি। দেখি দুটো বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে আছে। আমার সামনে মানুষের ক্ষতবিক্ষত দেহ… এসব কিছু দেখতে হয়েছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে কিছুই করতে পারিনি। কারণ, কাউকে বগি দুটি থেকে কাউকে বের করা যাচ্ছিল না।'
মুনিম যখন ঘটনাস্থলে যান, ততক্ষণে চারজন মারা গেছেন।
'ঘড়িতে সময় তখন ৩টা বেজে ২৫। আমাদের ট্রেন মাত্রই প্লাটফর্ম ছেড়ে ঢাকার ট্র্যাকে উঠলো বলে। হঠাৎ বেশ বিকট আওয়াজ এবং পর পর দুবার ভয়ংকর ঝাঁকি খেয়ে আচমকা স্থির হয়ে গেল এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস। আমার বগি ওই দুটো বগির একদম সামনে হওয়ায় এই ঝাঁকি এতটাই প্রবল ছিল যে, প্রায় ছিটকে পড়েছি আমার সিট থেকে। প্রথমে ভাবলাম, হয়ত কেউ ইমার্জেন্সি শিকল টেনেছে, কিন্তু পরক্ষণেই বুজলাম, শেকল টানলে তো ট্রেন এভাবে থামে না। হয়ত ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। তখনো জানি না পিছনে বেশ কিছু মানুষ লাশ হয়ে গেছে। কাঁধের ব্যাগ ট্রেনে রেখেই নেমে গেলাম কি ঘটছে বুঝার জন্য। বাম পাশ দিয়ে নেমে পিছনে গিয়ে দেখি আমাদের পিছের দুই বগি পড়ে আছে। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতা বোঝা যাচ্ছিল না। বাম পাশ থেকে শুধু বগি উলটে তার ছাদখানাই দেখা যাচ্ছিল। এরমধ্যে অনেকে আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে ফোনে অপরপ্রান্তের ব্যক্তিকে জানাচ্ছিলেন, অনেক মানুষ মারা গেছে। আমি কিন্তু বাম পাশ থেকে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তাই আবার আমার বগিতে ফিরে এসে আমার কাঁধের ব্যাগ নিয়ে এবার ডান পাশ দিয়ে নেমে পড়লাম ঘটনাটা বুঝতে। তারপর খুব বেশিক্ষণ লাগেনি নিজের চোখে দেখতে।'
'সবকিছু চোখের পলকে হয়েছে, ১০ সেকেন্ডের মধ্যে। আমার তো তাই মনে হয়েছে। সেখানে এক ঘণ্টা সাহায্যের অপেক্ষা করেছি। এরপর ফায়ার ব্রিগেড উদ্ধার তৎপরতা শুরু করলে, আমি চলে আসি।'
মুনিম জানান, যাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দরকার ছিল তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
'আমি নিজে এনেস্থেসিয়া এবং আই.সি.ইউ- এর ডাক্তার। তাই সড়ক বা বিভিন্ন দূর্ঘটনার শিকার গুরুতর আহত মানুষ দেখে দেখে নার্ভ বেশ শক্ত। অর্থাৎ, হাত-পা বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া- এসব দেখতে আমি অভ্যস্ত। কিন্তু, হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার সময় আমরা পাই অপারেশন থিয়েটার, কিংবা আইসিইউ। যেখানে একটা মরণাপন্ন রোগীকে স্টেবল করার মতন সকল ঔষধ বা সরঞ্জাম থাকে, আরও থাকে ট্রেইন্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিন্তু, আজ আমি যা দেখলাম তাতে শুধু শুধু চেয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।'
'আমি ঢাকায় ছুটি কাটাতে যাচ্ছিলাম। কখনো ভাবিনি তার মধ্যে এমন দুর্ঘটনা ঘটবে। কী ঘটে গেল- সেটা এখনও বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি, এই ঘটনায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছি, যতবার ভাবছি গা শিউরে উঠছে।'