যেভাবে হলুদ থেকে বিষাক্ত সিসা দূর করেছিল বাংলাদেশ, শেখার আছে প্রতিবেশীদেরও
তরকারিটা একটু ভালোমতো রান্না করতে হলে হলুদের দরকার — যেকোনো দক্ষিণ এশীয়ই বিষয়টি স্বীকার করবেন। তরকারিতে স্বাদ, গন্ধ আর রং বাড়িয়ে তুলতে এ মশলাটির জুড়ি নেই। অনেকেই মনে করেন হলুদ খাওয়া, এমনকি হলুদ মেখে স্নান করাও শরীরের জন্য উপকারী।
তবে দক্ষিণ এশিয়া এবং আরও অনেক স্থানেই এ হলুদের জন্যই মানুষকে ভয়ানক এক মূল্য চোকাতে হচ্ছে।
কারণ এসব জায়গায় বিক্রি হওয়া হলুদে নিয়মিত সিসা [লেড ক্রোমেট] মেশানো হয়। হলুদের রং আরেকটু ধারালো করতেই এ ভেজালের মিশ্রণ।
সিসা এক ধরনের নিউরোটক্সিন। এটি হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। খাবারে সিসার কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। কারণ সিসা শিশুদের অবধারণগত বিকাশকে প্রতিহত করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর শিশুদের তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের ২০ শতাংশ লার্নিং গ্যাপ-এর বিষয়টির পেছনে শিশুদের বিষাক্ত সিসার সংস্পর্শে আসার সম্পর্ক রয়েছে।
ল্যান্সেট প্ল্যানেটারি হেলথ-এ প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের রক্তে সিসার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এত ধাতুর উৎসকে সুনির্দিষ্ট করে শনাক্ত করা দুরূহ। কারণ এ অঞ্চলে রান্নার বাসনকোসন থেকে শুরু করে প্রসাধনী; সবকিছুতেই ধাতুর ছড়াছড়ি।
তবে ২০১৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্স, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি)-এর একদল গবেষক হলুদে ভেজালের বিষয়ে মনোযোগ দিলেন। তখন দেশের খাদ্য-নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মিলে দলটি হলুদে সিসার ব্যবহার সমূলে উচ্ছেদ করতে দেশজুড়ে ক্যাম্পেইন শুরু করলেন।
এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশের এ উদ্যোগ দারুণভাবে সফল হয়েছে।
দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশের বাজারে সিসাযুক্ত হলুদের পরিমাণ ৪৭ শতাংশ থেকে কমে ০ শতাংশে নেমে আসে। আর দেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ে প্রায় তাৎক্ষণিকই। হলুদ কারখানার শ্রমিকদের রক্তে সিসার পরিমাণ গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। নিউ ইয়র্কভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক এনজিও পিউর আর্থ-এর এক প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মাত্র এক ডলার খরচে স্বাস্থ্যকর জীবনে বাড়তি এক বছর যোগ করা গেছে। অন্যদিকে সরাসরি আর্থিকভাবে একই সাফল্য পেতে হলে আনুমানিক ৮৩৬ ডলার খরচ করতে হতো।
দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে দ্রুত নীতি বাস্তবায়নই একটি বিরল ঘটনা — সফল নীতি বাস্তবায়ন তো আরও দূরের কথা — সেখানে বাংলাদেশের এ সাফল্য সত্যিই আশ্চর্যজনক। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনা ফরসিথ বলেন, নীতিনির্ধারকদের কাছে সমস্যাটি বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে ব্যাখ্যা করার কারণেই তাদের কাছ থেকে সহজেই সমর্থন আদায় করা গেছে।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে ফরসিথ ও তার সহকর্মীরা বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় গর্ভবতী নারীদের মধ্যে সিসার উচ্চ উপস্থিতি ও হলুদ খাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক দেখাতে তথ্য সংগ্রহ করেন। এ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ফলাফল দেখিয়েই বাংলাদেশের খাদ্য-নিরাপত্তা বিভাগকে তো-ই, সেই সঙ্গে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে পর্যন্ত রাজি করাতে পেরেছিলেন গবেষকেরা।
এর অংশ হিসেবে গণমাধ্যমেও প্রচারণা চালানো হয়। সেগুলোতে সিসা মেশানো হলুদের ভয়াবহতা নিয়ে গ্রাফিক কনটেন্টের মাধ্যমে দর্শকদের সতর্ক করা হয়। এ সমস্যার বিষয়ে জাতীয় টেলিভিশনে কথা বলেন শেখ হাসিনা। বাজার ও পাবলিক এরিয়াগুলোতে হলুদে সিসা-বিষ নিয়ে প্রায় ৫০ হাজার বিজ্ঞপ্তি লাগানো হয়। কারখানা থেকে শ্রমিকদের রক্ত সংগ্রহ করে গবেষকেরা শ্রমিকদের দেহের বিভিন্ন রোগের সঙ্গে সিসার সম্পর্ক দেখিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করেন।
দেশে হলুদে ভেজাল মেশানো অপরাধ ঘোষণা করে সরকার। বড় একটি হলুদ প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরকারি অভিযান টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। ভেজালমিশ্রিত হলুদ বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই পাইকারি ব্যবসায়ীর দণ্ড দেন।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের প্রত্যাশা তারা ভারত ও পাকিস্তানেও একই ধরনের ক্যাম্পেইন শুরু করতে পারবেন। তাদের আশঙ্কা এ দুই দেশে হলুদে ভেজালের হার আরও বেশি এবং এ সমস্যা বাংলাদেশের চেয়েও তুলনামূলক গভীরে প্রোথিত। বাংলাদেশে হলুদে ব্যবহার করা বিষাক্ত সিসার বেশিরভাগই আমদানি হয়েছিল ভারত থেকে। আর বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে হলুদের সরবরাহ চেইন আরও বেশি বড় ও জটিল। ভারতে অল্পকিছু পাইকারি বিক্রেতা পুরো দেশে হলুদ সরবরাহ করে।
বাংলাদেশে এ ক্যাম্পেইনের বিস্তৃত পাঠটি সব ধরনের নীতিগত সমস্যায় প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করেন আইসিডিডিআর, বি-এর মাহবুবুর রহমান।