ভিসা থাকা সত্ত্বেও কানাডাগামী ৪৫ যাত্রীকে কেন ফেরত পাঠালো বিমান?
পর্যটক ভিসায় কানাডা যাওয়ার জন্য সিলেট থেকে রওনা দিয়েছিলেন ৪৫ জন যাত্রী। কানাডার ভিসাও ছিল তাদের। তবু বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তারা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেন তাদের। আমন্ত্রণপত্র সঠিক না থাকার অভিযোগ এনে এই ৪৫ যাত্রীকে অফলোড করে ফেরত পাঠায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই ঘটনাটি ঘটেছে গত ৭ নভেম্বর। তবে রোববার (১২ নভেম্বর) বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর থেকে এ ঘটনা নিয়ে সিলেটে চলছে তোলপাড়।
অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন- বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও বিমান কর্তৃপক্ষ কেন যাত্রীদের আটকাবে ? বিমানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সুবিধা আদায়ের জন্য যাত্রী হয়রানি ও জিম্মি করারও অভিযোগ উঠেছে।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিমান কর্তৃপক্ষ বলছে, কানাডা ইমিগ্রেশনের মতামতের ভিত্তিতে নিয়ম মেনেই এসব যাত্রীদের কানাডা যেতে দেওয়া হয়নি।
জানা যায়, গত ৬ নভেম্বর রাত ৮টা ২৫ মিনিটে বিমানের ফ্লাইট বিজি-৬০৬ যোগে সিলেট থেকে ৭৪ জন যাত্রী ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রী ছিলেন বিমানের টরন্টো ফ্লাইটের (বিজি৩০৫/৭ নভেম্বর, ২০২৩) যাত্রী।
বিমানের সিলেট স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তাগণ যাত্রীদের ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পান ৪৫ জন যাত্রী একই ব্যক্তির আমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে কানাডা যাচ্ছেন।
তাৎক্ষণিকভাবে যাত্রীদের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে সন্দেহ হওয়ায় সিলেট স্টেশন থেকে যাত্রীর নথি ঢাকাস্থ পাসপোর্ট কন্ট্রোল ইউনিটে (পিসিইউ) পাঠানো হয়।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ বিমানের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, "উক্ত ইউনিট ডকুমেন্টসমূহ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দিল্লিস্থ কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সির (সিবিএসএ) নিকট প্রেরণ করলে– প্রথমে তারা জানায় সিবিএসএ এর সিস্টেমে যাত্রীর তালিকায় যাত্রীর তথ্য সঠিক রয়েছে।"
ফলে সিলেট থেকে যাত্রীদেরকে বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করা হয় এবং যাত্রীরা ঢাকায় পৌঁছান।
"ইতোমধ্যে কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সি থেকে আবার জানানো হয় যাত্রীদের আমন্ত্রণপত্রের তথ্যের সাথে থাকার (আবাসন) বিষয়ে সিস্টেমে গরমিল রয়েছে। যাত্রীদের আমন্ত্রণপত্রে হোটেলে থাকার কথা থাকলেও– যাত্রীদের কাছে ভাড়া বাড়ির নথি পাওয়া যায়"- জানায় প্রেস রিলিজ। .
কানাডার আইন অনুযায়ী, একটি ভাড়া বাড়িতে ৪৫ জন পর্যটক থাকার কোন নিয়ম নেই এবং তা অগ্নিনিরাপত্তা বিধান লঙ্ঘন (বা ফায়ার কোড ভায়োলেশন) বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
বিমান জানায়, যাত্রীদের নথিপত্র ও কানাডা বর্ডার সার্ভিস এজেন্সির বার্তা পর্যালোচনা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শক্রমে ৪৫ জন যাত্রীকে ৭ নভেম্বর ২০২৩ তারিখ টরেন্টো ফ্লাইট থেকে অফলোড করা হয়।
বিমান বলছে, যাত্রীর নিকট যথাযথ নথিপত্র না থাকলে বা এ ধরনের লঙ্ঘনের জন্য – কানাডার কর্তৃপক্ষ যাত্রীপ্রতি সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সকে ৩,২০০ থেকে ২০,০০০ কানাডিয়ান ডলার পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে।
বিমানবন্দরে আটকে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে ৩ জনের সাথে কথা হয় সোমবার। তারা সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কাস্তরাইল এলাকার বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, "কানাডার টরেন্টোতে আমার ভাগনির বিয়ে ছিল। সেই বিয়েতে অংশ নিতে, এম্বেসিতে সকল কাগজপত্র জমা দেয়ার পর কানাডা আমাদের ভিসা দেয়। আমাদের ফ্লাইট ছিল সিলেট-ঢাকা-কানাডা। ৬ নভেম্বর, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে সব কাগজপত্র পরীক্ষা করেই আমাদের বোর্ডিং পাস দেয়া হয়।"
তিনি বলেন, "শাহজালাল বিমানবন্দরে আমাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে বিমানের এক কর্মকর্তা এসে বলেন- আমাদের হোটেল বুকিং নেই। পরে আমরা হোটেল বুকিং করে তার সব কাগজপত্র তাকে দিয়েছি।"
তিনি আরো বলেন, "এরপর ওই কর্মকর্তা আমাদের জানান, কানাডা ইমেগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আমাদের ব্যাপারে ই-মেইল করেছেন। সেখান থেকে ক্লিয়ারেন্স না আসলে আমরা যেতে পারব না। এভাবে নানান অজুহাতে আমাদের অনেকক্ষণ বিমান বন্দরে বসিয়ে রেখে, পরে ফিরিয়ে দেয়া হয়।"
এসময় বিমানের এক কর্মকর্তা তাদের কাছে টাকা দাবি করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এই পরিবারের আরেক সদস্য বলেন, "আমাদের ভিসা আছে। বিয়ের কার্ড, হল বুকিং সবই আছে। তারপরও বিমান কর্তৃপক্ষ আমাদের আটকানোর কে? আমাদের কাগজপত্রে কোন সমস্যা থাকলে, কানাডা যাওয়ার পর সেখানকার বিমানবন্দরে ইমেগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আটকাতে পারে। কিন্তু, কানাডা ভিসা দেওয়ার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ আটকাবে কেন?"
কানাডা যেতে না দিয়ে তাদের হেনস্থা ও আর্থিক ক্ষতির প্রতিকার চেয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবেন বলেও জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা পর্যটক ভিসা সহজ করায়– সিলেট থেকে এই ক্যাটাগরির ভিসায় কানাডা যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। পর্যটক ভিসায় কানাডায় গিয়ে অনেকে সেখানে থেকে যাওয়ারও চেষ্টা করছেন। পর্যটক ভিসায় কানাডা যেতে সেদেশে বসবাসরত কারো কাছ থেকে আমন্ত্রণপত্র আনাতে হয়। বিভিন্ন এজেন্সি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আমন্ত্রণপত্রসহ ভুয়া বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে যাত্রীদের বিপদে ফেলছে এমন অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে, যে বিয়ের আমন্ত্রণে ওই ৪৫ জন কানাডা যেতে চাইছিলেন, সেই একই বিয়ের আমন্ত্রণে আরও প্রায় ৩০ জন গত মাসে কানাডা গিয়েছেন।