হরতাল-অবরোধে বিপর্যয়ের মুখে শিক্ষার্থীরা, উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সহ সরকারবিরোধী দলগুলো যখন গত ২৯শে অক্টোবর হরতাল ডাকল, স্কুলগামী বহু শিশুর জন্যই সেটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা।
রাজনৈতিক আন্দোলনের এই ধরন দেশে গত কয়েক বছর অনুপস্থিত ছিল; অনেক শিক্ষার্থীকেই তাই এর প্রকৃতি বুঝতে তাদের অভিভাবকের শরণাপন্ন হতে হয়।
করোনা মহামারীর দিনগুলোর সাথে তুলনা করে তাদের তখন এ বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়, যখন স্কুল বন্ধ ছিল আর ক্লাস-পরীক্ষা অনলাইনে পরিচালনা করা হতো।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতি সপ্তাহে চারদিন করে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো; ইতিমধ্যে তাই শিক্ষার্থীরা হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছে। আবার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ফিরেছে অনলাইন ক্লাস, পরীক্ষার ধারায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এই মুহূর্তে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
এরইমধ্যে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে স্কুলের সব পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে কারণে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনও পরীক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছে অনেক স্কুল।
হরতাল-অবরোধের দিন উৎকণ্ঠা নিয়ে সন্তানদের পরীক্ষা দিতে পাঠাচ্ছে অভিভাবকেরা। বেশিরভাগ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে, পরীক্ষা হচ্ছে শুক্র ও শনিবার।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে, এবং তাদের সামাজিক দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও সামগ্রিক বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ কোভিড-১৯ মহামারীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং শিক্ষার উপর বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, "কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শিশুরা দুই বছর অটো-প্রমোশন পেয়েছে। তাছাড়া, নতুন পাঠ্যক্রমের জন্যও শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। আগে থেকেই বিদ্যমান চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।"
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, একাডেমিক কার্যক্রমের স্বাভাবিক প্রবাহে যেকোনো ব্যাঘাত শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের ধৈর্য্য ধারণ করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এ অবস্থায় শিশুর নিরাপত্তা এবং সুস্থতা নিশ্চিত করা প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকার স্কুলগুলো
ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আসমা বেগম বলেন, "১০ তারিখ থেকে আমাদের স্কুলে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ৯৯% উপস্থিতি আছে, অসুস্থতার কারণে কেউ কেউ আসছেনা। নভেম্বরেই পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে হবে তাই শনিবারও পরীক্ষা নিচ্ছি।"
১৯ ও ২০ নভেম্বর সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডেকেছিলো বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। রুটিন অনুযায়ী এই দু'দিন যেসব পরীক্ষা ছিল, তা এগিয়ে নিয়েছিলো রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। স্কুলটি প্রথম থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রোববার ও সোমবারের (১৯-২০ নভেম্বর) পরীক্ষা পরিবর্তন করে শুক্রবার ও শনিবার (১৭ ও ১৮ নভেম্বর) নেয়। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির রোববারের (১৯ নভেম্বর) সব পরীক্ষা ১৮ নভেম্বর শনিবার নেয়া হয়।
গত ১৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক নোটিশে বলা হয়, "পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ২৪ ও ২৫ নভেম্বর অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা হতে পারে। এ বিষয়ে নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দেয়া হবে।"
রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছে অভিভাবকেরা।
সালমা আফরোজ নামের এক অভিভাবক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমার মেয়ে সহজপাঠ উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনের পরীক্ষা দিচ্ছে, হরতাল-অবরোধে উৎকণ্ঠার মধ্যে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছি। বেশিরভাগ পরীক্ষা শনিবার ছুটির দিনে হচ্ছে। এর মধ্যে রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছেনা। দেখা যাচ্ছে শেষের দিকে যে পরীক্ষাটা রুটিনে ছিলো তা অবরোধের বিরতিতে মঙ্গলবার হচ্ছে। সিডিউল পরিবর্তন হওয়ায় বাচ্চার প্রিপারেশনেও সমস্যা হচ্ছে।"
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আবুল কাশেম বলেন, "বার্ষিক পরীক্ষা হওয়ায় বাধ্য হয়ে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছি। তবে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর পর বাসায় না ফেরা পর্যন্ত উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়।"
রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫ নভেম্বর শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে তা পিছিয়ে ৯ নভেম্বর থেকে শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।
আবার কলেজগুলোতে এখন পরীক্ষা না হওয়ায় ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি একেবারে কম। লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী লামিশা রশিদ বলেন, "অবরোধে আমরা ক্লাসে যাইনা। যাদের বাসা কলেজের কাছে ও যারা হোস্টেলে থাকে শুধু তারাই কলেজে যায়।"
অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে প্রাইভেট ভার্সিটিগুলো
ঢাকার বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ বিভাগের সিনিয়র সহযোগী পরিচালক আনোয়ার হাবিব কাজল বলেন, "অনলাইনে ও ফিজিক্যালি একসাথে আমাদের ভার্সিটিতে ক্লাস চালু আছে। অবরোধ-হরতালে যেসব স্টুডেন্ট ক্লাসে আসছে তারা ফিজিক্যালি ক্লাস করছে, বাকিরা অনলাইনে ক্লাস করছে। এখন আমাদের ভার্সিটিতে কোন পরীক্ষা চলছেনা আগামী ১ ডিসেম্বর পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা আছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।"
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস স্থানান্তরিত করা হচ্ছে, তাই বেশ কয়েকদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির অনলাইনে ক্লাস চলছে। আগামী কিছুদিনও অনলাইনে ক্লাস চলবে বলে সূত্র জানায়।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে অবরোধের বিরতিতে মঙ্গলবার ফিজিক্যালি ক্লাস হচ্ছে আর বাকি দিনগুলোতে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। তবে শুক্র ও শনিবার ফিজিক্যালি পরীক্ষা হচ্ছে ইস্ট ওয়েস্টে।
ঢাকার বাইরে হরতাল-অবরোধের প্রভাব কম
হরতাল-অবরোধের প্রভাব পড়েনি ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।
সাভার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস, এম রফিকুজ্জামান বলেন, "এখন পর্যন্ত হরতাল-অবরোধের কোন প্রভাব আমরা পাইনি। স্কুলে পরীক্ষা চলছে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ রয়েছে।"
কুমিল্লার স্কুলগুলোতে বার্ষিক মূল্যায়ন ও পরীক্ষা চলছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা অবরোধের প্রথম দিকে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম ছিল, তবে এখন অনেকটা আতঙ্কের মধ্যে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন অভিভাবকরা।
কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ এফতেখারুল ইসলাম বলেন, "আমাদের কুষ্টিয়ার সমস্ত স্কুলগুলোতে রুটিন অনুযায়ী ক্লাস এবং পরীক্ষা চলছে, এখন পর্যন্ত কুষ্টিয়াতে হরতাল বা অবরোধের কারণে কোন স্কুলে ক্লাস বা পরীক্ষা বন্ধ থাকেনি।"
স্কুল এবং কলেজের পাশাপাশি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হরতাল এবং অবরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাস বা পরীক্ষা বন্ধ হয়নি।
এদিকে লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন কলেজ ও মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষায় পাঠদান স্বাভাবিক থাকলেও শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি কম।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ড. নূরজাহান বেগম বলেন, "হরতাল-অবরোধে পরীক্ষার রুটিনে আমাদের কোনো পরিবর্তন করতে হয়নি। হরতাল-অবরোধের দিনই যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও শতভাগ। তবে হরতাল-অবরোধে কলেজগুলোতে দূরের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কিছুটা কম।"
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন টিবিএসের কুমিল্লা প্রতিনিধি তায়্যেবুর রহমান সোহেল, রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব, সাভার প্রতিনিধি নোমান মাহমুদ, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি সানা উল্লাহ সানু এবং কুষ্টিয়া প্রতিনিধি এ জে সুজন)