বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী অভিবাসন বেড়েছে
বাংলাদেশ থেকে স্বল্প-দক্ষ (অদক্ষ হিসবে বেশি পরিচিত) কর্মী অভিবাসনের হার গত পঞ্জিকাবর্ষের তুলনায় এ বছর প্রায় ২৩ শতাংশ কমে ৬.২৬ লাখে দাঁড়িয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ (বিএমইটি) ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ রেকর্ড ১২ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষ কর্মী অভিবাসনের হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ এবং অদক্ষ শ্রমিক প্রায় ৫০ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান চলতি বছর ২২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২.৫২ লাখ, চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩.০৮ লাখ।
এ বছর প্রায় ২.৬১ লাখ লক্ষ আধা-দক্ষ কর্মী বিদেশে গেছেন, যেখানে ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪২ হাজার ৭৭১ জন।
এ বছর চিকিৎসক, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি বিশেষজ্ঞসহ ৫০ হাজার ১৫৮ জন পেশাদারও কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৪০ জন।
কর্মী নিয়োগকারীদের তথ্যমতে, কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে বেশি বিদেশে গেছেন ড্রাইভার, কেয়ারগিভার, গৃহকর্মী, আতিথেয়তা কর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান, কোয়ালিটি কন্ট্রোল সুপারভাইজার; রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনার, প্লাম্বিং ও পাইপ ফিটিং এবং সাধারণ বৈদ্যুতিক কর্মী।
বিশেষজ্ঞরা এবং নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এই অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্ববাজারের দক্ষ কর্মীর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে, কারণ দেশের অর্ধেক শ্রমশক্তিই অদক্ষ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে স্বল্প বেতনের শ্রমের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে ধরা হয়। এ কারণেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কর্মীপ্রতি কম রেমিট্যান্স পায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অদক্ষ বাংলাদেশিদের অভিবাসন বেশি হওয়ার মূল কারণ তৃণমূল পর্যায়ে ঠিকমতো কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করতে না পারা, মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ শ্রমিকদের বড় চাহিদা এবং স্থানীয় শিল্পগুলোতে প্রচুর প্রশিক্ষিত কর্মীর কর্মসংস্থান।
দেশে বিএমইটির অধীনে ১১০টির মধ্যে ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পুরোদমে চালু থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা মোট শ্রম অভিবাসীদের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি নয়।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয়ের না থাকায় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা-সরবরাহে অসামঞ্জস্য রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি সরবরাহের জন্য বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত ও পূর্ণ সজ্জিত নয়।
তবে প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারে। এর মধ্যে ৪০টি প্রকল্প চলমান আছে।
'দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বড় উদ্যোগ নেই'
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাজার অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি করতে আমরা পারিনি। সেজন্য বড় দাগে কোনো উদ্যোগ আমি দেখি না।'
তিনি আরও বলেন, 'বেশ কবছর যাবত নতুন বাজার অনুসন্ধানের কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু ভালো বাজারে ওইভাবে এক্সপ্লোর করা হচ্ছে না। দালাল বা সিন্ডিকেট যেসব মার্কেটে অপারেট করে, সেখানেই সবাই যায়। বিদ্যমান বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। এসব কারণে আমরা অদক্ষ কর্মী থেকে ফিরে আসতে পারছি না।'
'ঘরোয়া কাজের জন্য যারা যায়, তাদেরকে আমরা দক্ষ ক্যাটাগরিতে ফেলে দিই। এ কারণে হয়তো দক্ষ কর্মীর সংখ্যাগত বড় পার্থক্য হয়ে যায়। কিন্তু সার্বিকভাবে আমাদের দক্ষতার মাত্রা বাড়েনি,' বলেন তিনি।
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর বিষয়ে রোজানা রশীদ বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তারা ভাল জিনিসই অফার করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সমন্বয় নেই। কোন দেশে কত লোক কোন ট্রেডে দরকার, তা নিরূপণ করে সঠিক লোক বাছাই শেষে আমরা পাঠাতে পারছি না।'
তিনি বলেন, 'কোন লোকটা প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশের চাহিদা পূরণ করতে পারে, সে লোকটাকে জানানো এবং পাঠানো—তা হচ্ছে না। এটা অন্তত গত দুই দশকের সমস্যা।'
পুরোনো কর্মীদের দক্ষতার স্বীকৃতি এবং তাদের পুনরায় কর্মসংস্থান সফলভাবে হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন রোজানা রশীদ।
জনশক্তির বড় অংশই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বাইরে
বিএমইটি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ১১.৩৭ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছিল। কিন্তু ওই বছরে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর সংক্ষিপ্ত কোর্সের অধীনে মাত্র ১.২০ লাখ লোক প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন প্রশিক্ষণ পেয়ে ওই বছরেই বিদেশে গেছেন, তা জানে না কর্তৃপক্ষ।
বিএমইটির পরিচালক (ট্রেনিং অপারেশন) মো. সালাহ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'যারা ট্রেনিং নেয়, তাদের অনেকে বছরখানেক দেশে কাজ করে থাকে। তারপর সুযোগ বুঝে বিদেশে যায়। তবে আমাদের কাছে এই ডাটাটা থাকে না যে তারা কতজন বিদেশে গেল।'
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আগে আমরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে পারতাম, যা বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। নতুন উদ্বোধন হওয়া ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পুরোদমে চালু করা যায়নি। এগুলো চালু হলে আরেও বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে পারব।'
এই কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো মধ্যম পর্যায়ের সুপারভাইজার, রেফ্রিজারেশন, গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং সাধারণ ইলেকট্রিশিয়ানসহ শীর্ষ ৫৫টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়।
বৃহস্পতিবার ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে 'এফিশিয়েন্টলি প্রিপেয়ারিং দ্য ইয়ুথ ওয়ার্কফোর্স অভ আওয়ার কান্ট্রি অ্যান্ড ফ্যাসিলিটেটিং ইনটু দ্য গ্লোবাল প্লেসমেন্ট' শীর্ষক সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, 'আমরা প্রত্যেক জেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করেছি। এখনেও এগুলো দুর্বল, তবে আশা করি এগুলো আরো বেশি ইফেক্টিভ হবে।'
বড় বাধা ভাষাগত দক্ষতা
'প্রায়ই বিভিন্ন দেশ আমাদের কাছে ডাক্তার, নার্স, হোমকেয়ার, এল্ডারলি কেয়ার ইত্যাদি চায়। কিন্তু ভাষা না জানলে হয় না।
'হংকং থেকে আমাদের কাছ ২৮ হাজার জবের অফার এসেছিল, অথচ আমরা দুই হাজারও পাঠাতে পারিনি। আমাদের লোক আছে, কিন্তু সঠিক লোক নেই।'
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, 'আমরা এ বছর যুক্তরাজ্যে ৫ হাজার ৩০০ জন নারী কেয়ারগিভার পাঠিয়েছি। দুর্ভাগ্যবশত, তাদের অধিকাংশের ভাষাগত দক্ষতা এবং কারিগরি জ্ঞান খুবই কম। এদের অনেকেরই এখন চাকরি নাই, খুব কষ্টে আছে। তাই আমাদের অনেককে ফেরত নিয়ে আসতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আমরা এখন রোমানিয়া, পোল্যান্ড, গ্রিস, ইতালিসহ নতুন নতুন দেশ থেকে যথেষ্ট জব অফার পাচ্ছি। পোল্যান্ড কয়েকদিন আগে বলেছে, তারা এক লাখ লোক নিতে চায়। কিন্তু তারা দক্ষ লোক চায়।'
চলতি বছর প্রকাশিত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষণার তথ্য বচলে, প্রায় ৫২ শতাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী ভাষাগত দক্ষতা না থাকার মতো দুর্বলতার কারণে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য, আশ্রয় না পাওয়ার পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিএমইটির তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ থেকে এ বছরের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২.৪৬ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে, যা গত বছরের ১১.৩৫ লাখকে ছাড়িয়ে গেছে।
এ বছরের শ্রম অভিবাসনের একটি ইতিবাচক দিক হলো ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো অপ্রচলিত গন্তব্যে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী পাঠানো,।
কৃষি, আতিথেয়তা ও উৎপাদন খাতে ইতালি বাংলাদেশ ১৬ হাজার ২৯৭ জন কর্মী নিয়েছে, যা এক বছরে দেশটির জন্য রেকর্ড। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যও এ বছর রেকর্ড ৯ হাজার ৪২৭ জন কর্মী নিয়োগ করেছে। দেশটি মূলত কেয়ারগিভার, গৃহকর্মী ও আতিথেয়তা কর্মী নিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরেও এ বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী গেছেন।
কর্মীপ্রতি রেমিট্যান্সের পরিমাণ খুব কম
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে, একজন বাংলাদেশি প্রবাসীর পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্স হচ্ছে ২০৩.৩৩ ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুসারে ২২ হাজার ৩২৩ টাকা), যেখানে একজন ফিলিপিনো শ্রমিকের পাঠানো গড় মাসিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৫৬৪.১ ডলার। অর্থাৎ ফিলিপাইনে প্রবাসী কর্মীরা বাংলাদেশি কর্মীর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠান।
এছাড়া একজন পাকিস্তানি প্রবাসীর মাসিক গড় আয় ২৭৪.৭৪ ডলার এবং একজন ভারতীয় প্রবাসীর মাসিক গড় আয় ৩৮৫.৭১ ডলার, আর একজন চীনা প্রবাসীর মাসিক গড় আয় ৩৫২.৭১ ডলার।