ভাষার প্রতিবন্ধকতা ভোগাচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের, কম পাচ্ছে বেতনও
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়া বাংলাদেশী শ্রমিকদের অর্ধেকরই নেই স্থানীয় ভাষায় যোগাযোগের দক্ষতা। এতে বিদেশে কাজ করার সময়ে তাঁদের আয় ও জীবনযাত্রায় চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, ভাষাগত বাধাকেই তাঁদের মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে জানিয়েছেন ৫২ শতাংশ অভিবাসী কর্মী।
মূলত উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত ৪৭৯ জন প্রবাসী কর্মীদের মধ্যে এই গবেষণা পরিচালিত হয়; যা এই বছরের এপ্রিলে 'বার্ষিক শ্রম অভিবাসন প্রতিবেদন- ২০২১-২২' এ প্রকাশিত হয়েছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র তথ্যমতে, এখন দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও হংকংয়ে শ্রম অভিবাসনের জন্য ভাষা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব দেশের বিধিমালা মেনেই তা করা হয়েছে, তাই এসব অঞ্চলে যাওয়া বাংলাদেশী কর্মীদের কোনো জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না।
এদিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনশক্তি রপ্তানি গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে প্রধান ভাষা আরবি হলেও– সরকারিভাবে সকল অভিবাসী কর্মীর জন্য আরবি ভাষার কোর্স নেই। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা এক মাসের বাধ্যতামূলক আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভাষা শেখার জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের করা 'বিদেশে অভিবাসী কর্মীদের মৌলিক পরিষেবা এবং অভিগম্যতার মূল্যায়ন' শীর্ষক গবেষণামতে, প্রায় ৬৫ শতাংশ অভিবাসী কর্মী গন্তব্যের দেশগুলোয় দরকারি স্বাস্থ্য সেবা-বঞ্চিত; খাদ্য ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা পাচ্ছেন না যথাক্রমে ৬৯ ও ৪৪ শতাংশ।
গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রবাসী কর্মীরা জানান, কর্মক্ষেত্রে নানানভাবে অপদস্থ হওয়া– শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের প্রতিকার পেতে তাঁরা বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গন্তব্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী কর্মীরা নিয়োগদাতাদের কথাবার্তা সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না, ভাষাগত এই বাধার কারণে তাদের চাহিদার কথাও জানাতে পারেন না। এটি তাদের নিপীড়নের অন্যতম কারণ। ভাষাগত এই বাধার কারণে, তাঁরা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে এবং শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হলে– বিচার চাইতে সমস্যার সম্মুখীন হন।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) এর চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, "মূলত মধ্যপ্রাচ্যে নারী কর্মীরা গৃহস্থালি কাজে ভাষা না জানার কারণে– শারীরিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হন। অন্যদিকে, বেশিরভাগ পুরুষকর্মীরা ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ খাত, সার্ভিস সেক্টরসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করেন। যেখানে সরাসরি ভাষার কারণে সমস্যার সম্মুখীন না হলেও, তারা রেমিট্যান্সে পিছিয়ে থাকেন। তারা যদি স্থানীয় ভাষা জানতেন, তাহলে স্বল্প দক্ষ কাজে না গিয়ে আরেকটু ভালো কাজ করে বেশি আয় করতে পারতেন, যেটা আমরা শ্রীলংকা ফিলিপাইন, ভারত এসব দেশের অভিবাসী কর্মীদের ক্ষেত্রে দেখতে পাই।"
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর ২০১৯ সালের তথ্যমতে, প্রবাসী একজন বাংলাদেশী কর্মী মাসে গড়ে ২০৩ ডলার ৩৩ সেন্ট রেমিট্যান্স পাঠান। সে তুলনায়, ফিলিপিনো একজন কর্মী তাঁর দেশে পাঠান ৫৪৬ ডলার ১০ সেন্ট।
প্রবাসী একজন পাকিস্তানী কর্মীর মাসিক গড় আয় ২৭৫ ডলার ৭৪ সেন্ট, ভারতীয় কর্মীর আয় ৩৯৫ ডলার ৭১ সেন্ট এবং চীনা কর্মীর ৫৩২ ডলার ৭১ সেন্ট।
গবেষণার অন্যান্য তথ্য
গবেষণাটি জানায়, ভাষাগত দক্ষতার অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের বা দালালদের উপস্থিতি, প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহের অভাব ও প্রশিক্ষকদের দক্ষতার ঘাটতি থাকায় অভিবাসী কর্মীরা এসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে, অভিবাসন প্রক্রিয়া ও বা বিদেশ কাজের চুক্তির শর্ত সম্পর্কে তথ্যের অভাব, এবং বিদেশে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সাথে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট সম্পৃক্ততা না থাকার ঘটনা এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া কর্মীরা আরও জানান, যেসব দেশে তাঁরা কাজে যান সেখানকার সরকার, রিক্রুটিং এজেন্সি এবং সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস থেকেও তাঁরা যথেষ্ট সহযোগিতা পান না।
ভাষাগত বাধা ছাড়াও, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কর্মীরা বাড়তি সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হওয়া বা উৎসবকালীন ছুটির অনুপস্থিতিসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জও উল্লেখ করেন।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ কর্মী আট ঘন্টার বেশি কাজ করার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া, ২৪ শতাংশের বেশি প্রবাসী কর্মী সাপ্তাহিক ছুটি বা উৎসবকালীন ছুটি পাননি।
৫২ শতাংশ কর্মী জানান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার অভাব– তাদের কাজের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ৪২ শতাংশ প্রবাসী কর্মী তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বা সংস্থা থাকার অভাব অনুভব করেছেন বলে জানান, এবং ৩২ শতাংশ কর্মী নিজেদের দুর্ভোগের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবকে দায়ী করেন।
কর্মপরিবেশ উন্নতির জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি এবং বিদেশি সরকারের কাছ থেকে সহায়তা দরকার বলে জানিয়েছেন ১৬ শতাংশ বাংলাদেশী কর্মী, কিন্তু তারা কোনো সাহায্য পাননি। ১২ শতাংশ কর্মী গন্তব্যের দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে কোনো সহায়তা না পাওয়ার কথাও তুলে ধরেছেন।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে, গৃহপরিচারিক/গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করা ৪৯ জন পুরুষ এবং ২৭ জন নারী ছিলেন। এদের মধ্যে ১৪ শতাংশ পুরুষ গৃহপরিচারক তাদের নিয়োগকর্তাদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হন, নারী গৃহপরিচারিকার ক্ষেত্রে যা ছিল ৪১ শতাংশ। এছাড়া, প্রায় ৭ শতাংশ নারী গৃহপরিচারিকা যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী কোম্পানি দ্বারা নিযুক্ত থাকার সময় অপমান, অবহেলা এবং শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৪ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিদেশে পাঠানোর আগে কর্মীদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা, এবং নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলোর সাথে সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যকর সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র তথ্যমতে, এই বছরের ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ ৪৬ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। গত বছরে যান ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী। এরমধ্যে দক্ষ কর্মী গেছেন ২৫ শতাংশ এবং স্বল্প-দক্ষ কর্মী গেছেন ৫০ শতাংশ।বাংলাদেশ থেকে কম দক্ষ কর্মী অভিবাসনের হার– গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ২৩ শতাংশ কমে ৬ লাখ ২৬ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, "আমরা ইন্ডিভিজুয়াল গবেষকদের দিয়ে এই গবেষণাগুলো পরিচালনা করে থাকি। এসব গবেষণার একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে– অনেক সময় এগুলো প্রতিনিধিত্বমূলক হয় না, কারণ এই ধরনের গবেষণার জন্য যে পরিমাণ স্যাম্পলিং দরকার স্বল্প বাজেটের গবেষণায় তা সম্ভব হয় না।"
কর্মীদের বিপদ-আপদের সময় দূতাবাসগুলো যথাযথভাবে সাড়া না দেওয়ার যে অভিযোগ গবেষণায় উঠে এসেছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, "দূতাবাসগুলো সর্বোচ্চ পরিমাণ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে। তবে তাদের জনবল ঘাটতিসহ বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ আছে। অভিবাসী কর্মীদের সংকট নিরসনে আমরা আরো জোরালো ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছি ।"
ভাষাগত বাধা সমাধানের উপায় কী?
সবশেষ বার্ষিক শ্রম অভিবাসন প্রতিবেদনে- প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরামর্শ দিয়েছে, নতুন গন্তব্যের দেশে পাঠানোর আগে কাজের জন্য নির্দিষ্ট ভাষা এবং সংস্কৃতিতে দক্ষতা অর্জন করলে কর্মীরা আরও উপকৃত হবেন।
সারাদেশে ১০৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) পরিচালনা করে বিএমইটি। এরমধ্যে কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে। যেমন ৩২টি কেন্দ্রে ছয় মাসের জাপানি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। ১৬টি টিটিসি দিচ্ছে চার মাসের কোরিয় ভাষার প্রশিক্ষণ। ৮টি কেন্দ্রে দুই মাসের ইংরেজি শিক্ষার কোর্স রয়েছে। এবং তিনটি কেন্দ্রে তিন মাসের চীনা ভাষা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
কুমিল্লা টিটিসির প্রিন্সিপাল মো. কামরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের জাপানি ও কোরিয়ান ভাষার কোর্স আছে। তবে সরাসরি আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ না দিলেও– ড্রাইভিং কোর্স এবং হাউস কিপিং কোর্সে আরবি শেখানো হয়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যগামী নারী কর্মীদেরকে দুই মাসের আবাসিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে আরবি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা আছে।"
নারী কর্মীদের আরবি ভাষার প্রশিক্ষণ সম্পর্কে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. সাইয়েদা রোজানা রশিদ বলেন, "প্রশিক্ষেণ কেন্দ্রে যেভাবে ভাষাগুলো শিখানো হয়, দেখা যায় বিদেশে যাওয়ার পরে সেখানকার সাথে এখানে শেখা শব্দ বা উচ্চারণ মেলে না। এই ট্রেনিংটা আরো প্র্যাকটিকালভাবে দিতে হবে, যেখানে কাজের পরিবেশের বাস্তবিক পরিবেশে কথাবার্তার চর্চা থাকবে। এজন্য অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল কথা শুনতে হবে, বলতে শেখাতে হবে। প্রয়োজনে যেসব দেশে শ্রমিকরা যান, সেখানকার লোক এনে তাদের মতোন উচ্চারণ শেখাতে হবে। এতে প্রশিক্ষণের কার্যকারীতা অনেক বেড়ে যাবে।"
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসাদ মোর্তুজা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের পলিসিতে প্রচুর গণ্ডগোল আছে। শিক্ষা ব্যবস্থা তিন ভাগে বিভক্ত। ইংরেজি পড়ানোর জন্য যে মানের দক্ষ শিক্ষক দরকার, তা আমাদের নেই। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণেরও ঘাটতি আছে।"
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, "বিভিন্ন দেশ আমাদের থেকে ডাক্তার, নার্স ও কেয়ারগিভার নিতে চায়। কিন্তু, জনশক্তির ইংরেজি ভাষায় দরকারি দক্ষতা না থাকায়– আমরা যথেষ্ট সংখ্যক এ ধরনের কর্মী পাঠাতে পারিনি। কিছুদিন আগে আমরা হংকং থেকেও আমরা ২৮ হাজার কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব পাই, কিন্তু দুই হাজারও পাঠাতে পারিনি। আমাদের অনেক জনশক্তি আছে, কিন্তু উপযুক্ত দক্ষতাসম্পন্ন মানুষের ঘাটতি আছে।
"এবছর আমরা যুক্তরাজ্যে ৫ হাজার ৩০০ নারী কেয়ারগিভার পাঠিয়েছি। তাঁদের বেশিরভাগেরই ইংরেজি ভাষার দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞানের অভাব আছে। এদের অনেকেই এখন চাকরি হারিয়ে, দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। তাই অনেককেই আবার দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে"-যোগ করেন তিনি।